নভেম্বর মাসে বাংলার একটি প্রচলিত দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর বেরিয়েছিল। খবরে প্রকাশ, রাজ্যের গোয়েন্দারা সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল সিপিআইএম কৌশল করে বেশ কিছু ‘বেনোজল’ তৃণমূল কংগ্রেসে ঢোকাচ্ছে। প্রশ্ন হল, সরকারি গোয়েন্দারা কি কোন একটি বিশেষ দলের হয়ে এরকম রিপোর্ট তৈরি করতে পারে! সিপিআইএম-এর ‘কৌশল’ কেন, তার কোন উল্লেখ চোখে পড়েনি। ‘বেনোজল’ তো তৃণমূলের দলীয় ব্যাপার। তৃণমূলের কর্মীরাই তো এইরকম রিপোর্ট তাঁদের সুপ্রিমোকে দিতে পারতেন। ‘বেনোজল’ দেখার জন্যে গোয়েন্দার প্রয়োজন কেন পড়ল? এবার আরও নগ্ন ভাবে এই বিষয়টি সামনে এল।
এবার বাংলার অন্য আরেকটি প্রচলিত দৈনিকে প্রকাশ পেল আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। রাজনৈতিক সংঘর্ষ বিষয়ে যে নির্দেশনামাটি গোয়েন্দা বিভাগের মারফৎ জেলা পুলিশ অফিসারদের কাছে পৌঁছেছে তাতে রাজ্য পুলিশের ডিজি কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে রাজ্যের জেলায় জেলায় যেসব রাজনৈতিক সংঘর্ষ ঘটছে, সেই সব ঘটনায় শাসক দলকে ‘আক্রান্ত’ এবং বিরোধী দলকে ‘আক্রমণকারী’ হিসেবে সরাসরি চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নির্দেশনামায় শাসকের দল হিসেবে তৃণমূল এবং বিরোধী দল হিসেবে সিপিআইএম-এর নাম পরিষ্কার করে লেখা আছে। কিন্তু ওই খবরের কাগজটি লিখছে, ডিজি-র নির্দেশনামায় কোনও রাজনৈতিক দলের নাম নেই। রাজনৈতিক সংঘর্ষ সামাল দিতে ওসি-আইসি এবং গোয়েন্দা পুলিশের কী করণীয় তা-ই কেবল বলা হয়েছে। এই নির্দেশনামা নিয়ে এবার বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। আবার চাপা পড়েও যেতে পারে, কারণ ‘নির্দেশক’ তাতে ধরা পড়ে যেতে পারেন।
তৃণমূল দলটির প্রধান দুর্বলতা তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। পশ্চিমবঙ্গের কিছু বাংলা সংবাদপত্র তাদের সম্পাদকীয় এবং উত্তর সম্পাদকীয়তে আগে থেকেই লিখে চলেছে ‘লাল তৃণমূল’ এবং ‘সবুজ তৃণমূল’-এর কথা। নভেম্বর মাসের গোয়েন্দা রিপোর্টই তাদের সাক্ষী। তৃণমূলীদের দলীয় প্রধান যে কোন অঘটনে বারবার সিপিআইএম-এর দোষ খুঁজে পেয়ে এই ধরণের আলোচনাকে আরও উসকে দিয়েছেন। শাসক দলের মন্ত্রীরাও একই সুরে তাল মিলিয়ে তাদের কট্টর সিপিআইএম বিরোধী ভাব বজায় রাখার জন্যে যে কোন অকাজে বিরোধী দলের দোষ খুঁজে পেয়ে জনসমক্ষে বয়ান দিয়ে মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠছেন। রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগ যে স্বৈরাচারী সরকারি দলের সমর্থনে কাজ করবে তা না বললেও বোঝা যায়।
সিপিআইএমকে ‘হামলাবাজ’ বলে সরকারি ভাবে চিহ্নিত করতে পারলে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে খানিকটা হলেও ছাই ঢাকা দেওয়া যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে “এরপর যেখানে যা হবে (অঘটন) তার জন্যে সিপিএম দায়ী থাকবে”। আর সরকারি ভাবে যদি ‘হামলাবাজ’ বলা যেতে পারে তবে তৃণমূলের কর্মীদের সিপিআইএম কর্মী ও সমর্থকদের পেছনে লেলিয়ে দিতেও সুবিধা হবে। যদি সিপিআইএম-এর ওপর হামলা করতে হয় তবে যে কোন গোষ্ঠীর তৃণমূলীরা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন তারা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভুলে তাদের একমাত্র লক্ষ্যে অবিচল থাকে। দলীয় দ্বন্দ্ব থেকে দুষ্কৃতীদের সরিয়ে রাখতে তাদের অন্য কিছু খোরাক দিতে হবে। তাই গোয়েন্দা দফতরের নকল এবং বিকৃত নির্দেশনামার মারফৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরোক্ষে তাঁর দলকে একটি বার্তা প্রেরণ করলেন শুধু।
রাজ্য পুলিশ এবং রাজ্য গোয়েন্দা দফতর একই নির্দেশনামায় পৃথক বয়ানকে কেন্দ্র করে রহস্যের গিঁট কিন্তু লুকিয়ে আছে গোয়েন্দা দফতরের কার্যকলাপের মধ্যে। এখনও কিছু পুলিশ কর্তা হয়তো পুরোপুরি সবুজ হতে পারেননি। কিন্তু গোয়েন্দা বিভাগটি আজকাল সবুজ জামা গায়ে চাপিয়ে গোয়েন্দাগিরি করছে তা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। তাই আসল নির্দেশনামা এবং তাকে বিকৃত করে নিজের পছন্দ মতো জায়গায় রাজ্যের আইবি দুটি রাজনৈতিক দলের নাম বসিয়ে ওই দৈনিক সংবাদপত্র অনুযায়ী ‘রহস্য ঘনীভূত’ করেনি। বরং রহস্যের সরলীকরণ করে ফেলেছে। ‘রহস্য’ আর রহস্য নেই। রহস্য এখন জলবৎ তরলম। রহস্যের গিঁট খুলতে মানুষকে খুব বেশি ভাবতে হবেনা। গোয়েন্দা বিভাগের সেই কর্মী যিনি নির্দেশনামাটি জেলা পুলিশ দফতরগুলিতে পাঠিয়েছেন তিনি নিশ্চয়ই বিরোধী দলের কর্মী বা সমর্থক। এখন শুধু এইটুকু শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
ডিজির শাস্তির দাবি করলেন সূর্যকান্ত মিশ্র
ডিজির শাস্তির দাবি করলেন সূর্যকান্ত মিশ্র