আলাদিনের একটি প্রদীপের বিপুল শক্তি আমরা পড়েছি আরব্য রজনীর গল্পমালায়। এবার আলাদিন তার চল্লিশটি প্রদীপ নিয়ে বাংলায় নামতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার সল্টলেকের স্বাস্থ্যভবনে একটি অনুষ্ঠানে আলাদিনের হাতে চল্লিশটা প্রদীপ গুঁজে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে তিনি কি আলাদিনের চল্লিশটি প্রদীপ হাতে নিয়ে বসে আছেন! ৩৪ বছরে যা হয়নি তা কি করে কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে! মুখ্যমন্ত্রী আলিবাবার চল্লিশজন চোরের সঙ্গে আলাদিনের একটি প্রদীপকে এবার গুলিয়ে দিয়ে এই রাজ্যের মঙ্গল করলেন। কারণ এই রাজ্যে এখন আলাদিনের প্রদীপ দরকার। একটি প্রদীপের জায়গায় চল্লিশটি প্রদীপ দরকার।
পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন থমকে গেছে। ‘রেগা’র কাজ বন্ধ। রাজ্যের নিজস্ব রিপোর্ট জানাচ্ছে, বামফ্রন্ট সরকারের ঐ আট মাসে রেগায় শ্রমদিবস তৈরি হয়েছিল ১০৮২.২৬ লক্ষ। সেই একই আট মাসে চলতি আর্থিক বছরে মমতা ব্যানার্জির সরকার গ্রামাঞ্চলে শ্রমদিবস সৃষ্টি করতে পেরেছে গত বছরের তুলনায় তেত্রিশ শতাংশ মাত্র। এবার মে থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই সময়ে শ্রমদিবস সৃষ্টি হয়েছে ৩৫৮.৯২ লক্ষ। মারাত্মক অবস্থা আদিবাসী, মহিলা, তফসিলী জাতির অংশের। মহাকরণ থেকে জেলাশাসকদের নির্দেশ দিয়ে, সরকারী অফিসার, আমলাদের দিয়ে গ্রামোন্নয়নের কাজ চালানোর মডেল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলাই বাহুল্য। রাজ্যের অধিকাংশ সভাধিপতিদের মতামত পঞ্চায়েতকে নিষ্ক্রিয় করার কারণেই এই দুরবস্থা হয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাসের আবহাওয়া এবং রাজ্য সরকারের সময়মত টাকা না ছাড়ার কারণেই এই নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়তে হল গরীব গ্রামবাসীদের। আলাদিন তার একটি প্রদীপ এখানে ধার দিলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে বাধ্য।
NABARD বলছে এই আর্থিক বছরে এই রাজ্য তাদের ‘রুরাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’এর বরাদ্দ টাকা খরচ করতে অক্ষম থাকলে আগামী আর্থিক বছরে নিয়ম অনুযায়ী কম টাকা পাবে। অর্থাৎ বিভিন্ন গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প বাধা পেতে বাধ্য। বলা হচ্ছে ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার ৪২% খরচ করেছে রাজ্য। আর দু’মাসের কিছু কম সময়ের মধ্যে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ না করতে পারলে রাজ্যের গ্রামগুলির উন্নয়ন আরও থমকে যেতে পারে। এই মুহূর্তে আলাদিনের কয়েকটি প্রদীপ এখানে আনলে ভাল হয়।
রাজস্ব আদায় কমে গেছে। চলতি আর্থিক বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে রাজ্য। সরকার বদলের পর রাজস্ব আদায়ে অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। যে সব ক্ষেত্র থেকে কর বাবদ সরকারের কোষাগারে বেশি অর্থ আসে, গত অর্থবর্ষের তুলনায় এ বার তার প্রায় সবগুলো থেকেই আদায় কমেছে। গত অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সামান্য বেশি। সে বার আগের বছরের ওই সময়ের তুলনায় কর আদায় বেড়েছিল ২৭.৫৯%. চলতি বছরে ওই একই সময়ে বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়িয়েছে ১৫.৫৪%. বাড়তি রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা খাতায় কলমে থেকে গেছে। এখানেও আলাদিনের কয়েকটি প্রদীপ দরকার। নইলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোন যাবেনা।
আরও কয়েকটি প্রদীপ লাগবে কিছু জায়গায়। যেমন বিদ্যুৎ সংকট। যেমন শিশুমৃত্যু সংকট। যেমন কৃষক আত্মহত্যা সংকট। যেমন পেনশনধারীদের পেনশন দেওয়াতে সংকট। যেমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সংকট। যেমন দলীয় ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে সংকট। যেমন শরিকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার সংকট। সবার ওপরে সিপিআইএম-এর মতো শক্তিশালী একটি বিরোধী দলের বিরোধিতার সংকট। এত সংকট এক সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে যে আলাদিনের চল্লিশটি প্রদীপও অপ্রতুল মনে হতে পারে।
আলাদিন চল্লিশটি প্রদীপ নিয়ে মাঠে না নামতে পারলেও বাংলার ঘাটে মাঠে আলিবাবার চল্লিশজন চোরের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। সে গল্প থাক। পরে কোন দিন করা যাবে।