বেলা দশটা। ভজনের চায়ের দোকান আজ গুলজার। হরেক রকম লোক এসে জুটেছে আজ। চায়ের গেলাস কম পড়ে যাচ্ছে। ভজন ভাবছে, জয় মা, আর কিছু ভুলভাল বলো তুমি। তবে আমার চায়ের ব্যাবসা জমবে ভাল। ভজনের পেয়ারের কুকুর ভুলু। ভুলু ভেউ ভেউ করে ডেকে উঠল। অর্থাৎ আমিও আছি আড্ডায়। সেলুন খোলার আগে নিতাইও খানিকটা আড্ডা দেয় এখানে। নিতাই বলল, আজ ঠান্ডাটা কিন্তু জব্বর পড়েছে। প্রায় তিন কিলো হবে।
পঞ্চু চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল। কি বললি? তিন কিলো ঠান্ডা! মাথাটা তোর গেছে। চুল কেটে কেটে তোর বুদ্ধিটা চুলোয় গেছে। ঠান্ডা মাপে ডিগ্রি দিয়ে বুঝলি নিতাই। আজ ঠান্ডাটা ভালই। কালকের চেয়ে তিন ডিগ্রি কম।
নিতাই বলল, তুমিও যে কি বল পঞ্চুদা! ডিগ্রি মানে ডক্টরেট ডিগ্রি। এমএ ডিগ্রি। বিএ ডিগ্রি। ওটা দিয়ে ঠান্ডা মাপা যায় কি ভাবে আমাকে বোঝাও। আমি জাতে নাপিত। আমার মাথায় তোমার চেয়ে বেশি ব্রেন আছে।
পাশেই ছিল বংশীবদন। তার ভ্যান রিক্সার ওপর বসে পা দোলাচ্ছিল। বংশীর মামা এসেছে বর্ধমান থেকে। বংশী তাকেও নিয়ে এসেছে চায়ের আসরে। বংশী কনুই দিয়ে মামাকে এক ঠ্যালা মারল। তার মানে মামা তুমি চুপ থেকো না। তোমার বিদ্যেটা এবার একটু ঝাড়ো। মামা চাদরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে জবুথবু হয়ে ভ্যান রিক্সার ওপর বসে বসেই বলল, ঠান্ডা পড়েছে বটে। কিন্তু ক’কিলো বলতে পারবনা ভাই। এই রকম ঠান্ডা আরেকবার পড়েছিল। আমার ক্ষেতে আলু পাতার ওপর হাত রাখা যেতনা। মনে হত আঙুল কেটে বেরিয়ে যাবে। সে অনেকদিন আগের কথা ভাই। তবে আলুর দাম তখন ছিল এক টাকা কিলো। এখনও এক টাকায় পাঁচ কিলো। তার মানে ঠান্ডাটা এবারেই ওর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি পড়েছে।
ভজনের ভুলু গুটি পায়ে রাস্তা পেরিয়ে মাধবদার কচুরির দোকানে যেতে গিয়ে তাড়া খেল। হাতে ফুলের ডালি নিয়ে কনকের কাকিমা মন্দিরে যাচ্ছিলেন। ওরে ভজন, তোর পোলাটারে সামাল দে। দেখ আমার হাতে বাতাসা দেখে পেছু ধরেছে। অ্যাই ভুলু হাট। কুলাঙ্গার কুত্তা কোথাকার। ওদিক থেকে মাধবদা এই সব দেখে বলল, আপনি চলে যান কাকিমা। ও আমার দোকানে এঁটো পাতা চাটতে আসছে। আপনি রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে ওকে ধমকাচ্ছেন। তাই ও কি করবে তার কিনারা করে পারছেনা। ও আপনাকে ছোঁবেনা। আপনি বরং পুজো করে আসার সময়ে একটা বাতাসা ওকে দিয়ে যাবেন।
নিতাই ফুট কাটল। কাকিমা, অরে কুত্তা কয়েননা। আমাগো দ্যাশে কুত্তার জাত আলাদা। অরে ভুলু কয়েন। কনকের কাকিমা নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ব্যাজার করে বললেন, কি যে তুই বলিস নিতাই! আমি কিচ্ছু বুঝিনা। তোর এই হেঁয়ালি কবে বন্ধ করবি বল তো! তুই পলিটিস করিস বলেই জানি। কথায় কথায় তুই পলিটিসের প্যাঁচ মারিস। এবার কাকিমা গলার সুর আরেকটু চড়িয়ে বললেন, তুই কারে কুত্তা কইলি খুলে ক’। একটু ঝেড়ে কাশ। তোর পলিটিস তোর দোকানেই রাখ।
ভজন দেখল এবার হাওয়া গরম হতে পারে। হাওয়া গরম হলে এ ভিড়টা কাকিমার ভয়ে কেটে পড়তে পারে। চায়ের ব্যাবসা যখন আজ জমে গেছে তখন কায়দা মেরে কাকিমাকেই কাটিয়ে দেওয়া যাক। ও কাকিমা, পুজোর ফুল হাতে নিয়ে কেন কুত্তা কুত্তা বলছেন? অ্যাই ভুলু কাকিমাকে যেতে দে। পুজোর মধ্যে ব্যাগড়া দিস না। ভুলু ভাগ। মালিকের হাঁক ডাক শুনে ভুলু পেটের নিচে লেজ সাঁটিয়ে মাধবের কচুরির এঁটো ঠোঙার দিকে না গিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে দৌড় মারল। ভজন বলল, কাকিমা, রাস্তা পরিস্কার করে দিলাম। তাড়াতাড়ি পুজো দিয়ে আসুন। উপোস আছে তো। বেশি বেলা করে ফেললে পিত্তি পড়বে। যান কাকিমা। যান।
ভজনের কাকা ভানুবাবু। তিনি আবার আমিন। মাপজোক তাঁর একেবারে কন্ঠস্থ। পঞ্চু এইবার ভানুবাবুকে ধরল। এই যে ভানুবাবু, শুনুন নিতাইয়ের কথা। একটু বলে দিন ঠান্ডা কি দিয়ে মাপে। আমি ভাই পড়াশোনা করিনি। আপনি তো করেছেন। নিতাইকে বুঝিয়ে বলুন। আমি বলেছি ঠান্ডা মাপে ডিগ্রি দিয়ে। নিতাই জানেই না। এদিকে বিজ্ঞের মতো ফোড়ন কাটে। ভানুবাবু, এই মাথা নিয়ে ও কি করে চুল কাটে বলেন দেখি।
ভানুবাবু এবার খবর কাগজ থেকে মাথা তুলে নাকের ওপর চশমার ফাঁক দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে পঞ্চুর কানের সামনে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন। পঞ্চু চোখ গোল গোল করে ভানুবাবুর দিকে তাকিয়ে দু’দন্ড চুপ থেকে মাথা নাড়িয়ে ভানুবাবুকে বুঝিয়ে দিল যে উনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা পঞ্চু বুঝে ফেলেছে। ভানুবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার খবরের কাগজের দিকে মন দিল।
পঞ্চু এবার নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাল। নিতাই তুই বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা। পাবলিক তোদের লাথি মেরে তাড়িয়েছে। তোরা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবিস বুঝি। সামান্য একটা ভুল করে সে ‘সেন্টিগেট’ বলে ফেলেছে। তা বলে তুই তাকে অপমান করবি। তুই একজন মহিলাকে অপমান করলি? এই মহিলা যে বাংলার কত উন্নতি করে দিল তা তুই চোখে দেখলি না! ভানুবাবু আপনি একে বুঝিয়ে দেবেন। এর দোকানে আমি আর কোনদিন চুল কাটতেও ঢুকবনা। বেঞ্চি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পঞ্চু গটগটিয়ে দোকান ছাড়ল। ভজন বলল, চিন্তা নেই, আমাদের মা এরকম অনেক ভুলভাল বলবেন। আর আমার চায়ের ব্যাবসা আসছে বছরগুলোয় ভালই জমবে। হে ঠাকুর, মা যেন রোজ রোজ কিছু কিছু ভুল বকেন। হে ঠাকুর আপনি আমাকেও একটু দ্যাখেন। নিতাই বলল, পঞ্চুদা, রাগ করেন ক্যান! ডিগ্রিটা তো ফল্স। ঠান্ডাটা সত্যিই জব্বর পড়েছে। কালকের চেয়ে দু’ইঞ্চি কম।
পঞ্চু এবার নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাল। নিতাই তুই বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা। পাবলিক তোদের লাথি মেরে তাড়িয়েছে। তোরা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবিস বুঝি। সামান্য একটা ভুল করে সে ‘সেন্টিগেট’ বলে ফেলেছে। তা বলে তুই তাকে অপমান করবি। তুই একজন মহিলাকে অপমান করলি? এই মহিলা যে বাংলার কত উন্নতি করে দিল তা তুই চোখে দেখলি না! ভানুবাবু আপনি একে বুঝিয়ে দেবেন। এর দোকানে আমি আর কোনদিন চুল কাটতেও ঢুকবনা। বেঞ্চি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পঞ্চু গটগটিয়ে দোকান ছাড়ল। ভজন বলল, চিন্তা নেই, আমাদের মা এরকম অনেক ভুলভাল বলবেন। আর আমার চায়ের ব্যাবসা আসছে বছরগুলোয় ভালই জমবে। হে ঠাকুর, মা যেন রোজ রোজ কিছু কিছু ভুল বকেন। হে ঠাকুর আপনি আমাকেও একটু দ্যাখেন। নিতাই বলল, পঞ্চুদা, রাগ করেন ক্যান! ডিগ্রিটা তো ফল্স। ঠান্ডাটা সত্যিই জব্বর পড়েছে। কালকের চেয়ে দু’ইঞ্চি কম।