মগরাহাটের বিষমদ কান্ডের মৃত মাতাল পিছু দু’লাখ দশ হাজার টাকা না দিয়ে একটা করে রিকসা, ঠ্যালা রিকসা, সেলাই মেশিন কিংবা এই জাতীয় অন্য কিছু কিনে ওদের পরিবারের হাতে তুলে দিতে পারলে কর্ম সংস্থান হতে পারত। দু’লাখের ঘোষণায় তেমন কিছু লাভ হবেনা। তবে চোলাই খেয়ে আবার লোক মারা গেলে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে অনেকে নড়ে চড়ে বসতে পারে। অন্যান্য নিষিদ্ধ বস্তু খেয়ে লোক রোগাক্রান্ত হলেও ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হোক। মৃত মাতাল পিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে নেশা করার জন্যে মানুষকে উৎসাহ দেওয়া হল না তো!
চুল্লু খেয়ে ১৭০ জন মানুষ মারা গেছে কিছুদিন আগে। তাদের প্রত্যেক পরিবার পিছু দু’লাখ টাকা আর মৃতদেহ সৎকারের জন্যে দশ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা আগেই হয়ে গেছে। এরকম অভাবনীয় ঘোষণা ভূভারতে এই প্রথম। নিষিদ্ধ বস্তু পান করে পানাসক্তরা ইহলোক ত্যাগ করল। দুঃখে উথলে উঠল সরকার। স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ জাগে। মনে হয় মাতালেরা এখন ক্ষমতায় রয়েছে। মাতাল মারা গেলে মাতালেরা সাহায্যের হাত বাড়াবে এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবু সন্দেহ হয়। তড়িঘড়ি করে মাতাল পিছু এত টাকা দানের ঘোষণা করে বাকি মাতালেরা শুঁড়ির ঠিকানা লুকিয়ে ফেলার ফন্দি করল কি? মৃত মাতালের বাড়ির লোক রেগেমেগে যদি বলে দিত যে বিগত সাতমাসে চুল্লু আরও সহজলভ্য হয়ে গেছে। চুল্লুর ঠেক বেড়ে গেছে। চুল্লু খাওয়ার হারও বেড়ে গেছে। এসব যদি জানাজানি হয়ে যায় তবে আসল মাতালদের সততা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই কি আগেভাগে মুখ বন্ধ রাখার জন্যে ঘুষের ঘোষণা? সরকারি মাতালদের চোলাই দরদ দেখে সন্দেহ জাগে।
দিন কয়েক আগে চোলাই কারবারিরা জয়নগরের এক জায়গায় চার পাঁচটি পোস্টার মেরেছিল। তাদের পুনর্বাসনের দাবিতেই এই পোস্টার ছিল। ৩০০০০ শুঁড়ির পুনর্বাসন চাই। শুঁড়িরা খুবই গরীব তাই নাকি কাজের অভাবে তারা চোলাই বেচার কারবার করে! যুবা সংগ্রাম সমিতি তাই এদের দাবি নিয়ে পোস্টার সেঁটে দিল। কোন আন্দোলন নেই। কোন জনমত নেই। দাবির গ্রাহ্যতা নিয়েও কোন চর্চা নেই। সরকারি কোন পরিকল্পনাও নেই। কিন্তু পাঁচটি পোস্টার সাঁটার পরই তাদের দাবি পুরোপুরি মেনে নেওয়া হল। অর্থাৎ আবার এক মাতালি ঘোষণা, ‘চুল্লু কারবারিদের পুনর্বাসনের জন্যে প্যাকেজ দেওয়া হবে’। এ ঘটনাও অভূতপূর্ব। ভূভারতে আজ পর্যন্ত পাঁচটা পোস্টার মেরে কেউ কোন দাবিই আদায় করতে পারেনি। ‘পুনর্বাসনের প্যাকেজ’এর দাবি অনেক বড় দাবি। পুনর্বাসনের দাবিতে কয়েক দশক ধরে ভারতের বহু অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষ আন্দোলন করছে। রক্ত ঝরাচ্ছে। পুলিশের গুলি খেয়ে মরে যাচ্ছে। কিন্তু প্যাকেজ পাচ্ছেনা। তাই চুল্লু কারবারিদের জন্যে সরকারি মাতালদের সবচেয়ে বেশি দরদ দেখে সন্দেহ জাগে।
পুনর্বাসনের দাবিতে একদিন পাঁচটি মাত্র পোস্টার সাঁটিয়ে নিজেদের দাবি পুরোপুরি মানিয়ে নিয়ে চুল্লুর দোকানদারদের কি কি লাভ হল? হতে পারে এর ফলে ওদের ওপর নিষিদ্ধ পানীয় বিক্রি করার জন্যে যে সব শাস্তি হওয়া উচিত ছিল তার থেকে তারা রেহাই পেল। হতে পারে এর ফলে অনেক রাঘব বোয়ালও ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল। হতে পারে পুনর্বাসনের দাবি নিয়ে পুনরায় সোচ্চার হতে অনেকেই আবার চোলাইয়ে ঠেক খুলে বসে পড়ল। ধরা পড়লে শাস্তির ভয় নেই। ধরা পড়লে পুনর্বাসনের প্যাকেজের লোভের হাতছানি। মাতালদের হাতে দেদার টাকা এসে পড়লে সেই টাকা শুঁড়ির ঘরেই ঢোকে। তাই শুঁড়িদের ঘরে ‘প্যাকেজ’এর টাকা তুলে দেওয়া হোক।
রাজনৈতিক ভাবে তৃণভোজী চুল্লুপায়ী দলটির কি কি লাভ হল? তদন্তে এই দলটির চাঁইদের নাম উঠে আসতে পারত। চোলাইয়ের ঠেক চলে রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেলে। তার ফলে পুলিশও চুপ থাকে। মাসোহারা পায় রাজনৈতিক দলের মাতালরা আর পুলিশেরা। এখন হঠাৎ পুলিশের তাড়া খেয়ে চুল্লুর দোকানদারদের কোথাও কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে ঘোরাফেরা করতে হচ্ছে। ধরপাকড় হলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে বইকি। গত সাতমাসে চোলাই বিক্রি যে বেড়ে গেছে এ কথা খোদ আবগারি বিভাগ থেকেই বলা হয়েছে। তাই পুনর্বাসন দিয়ে বেমালুম চেপে দেওয়া হোক রাজনৈতিক মাতালদের কারবার। চোলাইয়ের চল কমবেনা। দলটির মাতালদের রোজগারও কমবেনা। শুধু যারা ধরা পড়ে যাবে তাদের পুনর্বাসনের প্যাকেজ ধরিয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং নিরাপদে চোলাই বেচতে পার। বলা যায় এর ফলে রাজনৈতিক মাতালদের রোজগার আরও বেড়ে গেল। কারণ ধরা পড়লে প্যাকেজের বন্দোবস্ত তো এরাই করে দেবে। তাই এই ধরণের ‘বীমা’র কিস্তি যে মাসোহারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল তা না বললেও চলে। যদি তদন্ত করা যেত যে ‘যুবা সংগ্রাম সমিতি’র নাম লিখে পোস্টার কারা মারল তবে বুঝতে পারা যেত মাত্র পাঁচটা পোস্টার মেরে শুঁড়িরা কিভাবে পুনর্বাসনের দাবি আদায় করে নিতে পারল।
শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল। শুঁড়ির বন্ধুও মাতাল। তাই মাতাল মরলে শুঁড়ি আর মাতাল দুজনেই মরাকান্না কেঁদে নেয়। আবার শুঁড়ি যদি বিপদে পড়ে তবে তাকে বাঁচাতে মাতালরাই এসে হাজির হয়। এখন মগরাহাট ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শুঁড়িদের বিপদ চলছে। তাই তাদের পুনর্বাসনের সাহায্যের ঘোষণা যদি মাতালেরা করেই দিয়েছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সন্দেহেরও কোন অবকাশ নেই। যুবা সংগ্রাম সমিতি নামের অজানা ‘সমিতি’র পাঁচটা পোস্টার দেখতে পেয়ে একমাত্র এই মাতালের রাজ্যে শুঁড়িদেরই পুনর্বাসন সম্ভব। মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যাক। শিশুমৃত্যু বেড়ে যাক। মাতাল আর শুঁড়ির বন্ধন অটুট থাকুক। মানুষ ভোগে যাক।