তখনও মাঝে মাঝে অনাবৃষ্টি হত। তার দরুণ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দেখা দিত। দেশে খাদ্যশষ্যের অভাব হয়ে পড়ত। মানুষ অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাতেন। এই অবস্থায় মানুষ যা সামনে পেতেন তাই খেতেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র ছিলেন অগ্নিসম তেজস্বী ও মহাতপস্বী। এক দুর্ভিক্ষের সময়ে তিনি এক দুর্ভিক্ষ কবলিত গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। গ্রামের শেষে চন্ডালপাড়া। তিনি গ্রাম ছাড়িয়ে চন্ডালপাড়ায় ঢুকলেন। যেতে যেতে কোন এক চন্ডালের ঘরের দাওয়ায় তিনি মরা কুকুর দেখলেন। ক্ষিধের জ্বালায় বিশ্বামিত্রের মরা কুকুরটিকে খেতে ইচ্ছে হয়। তিনি লোভে পড়ে মরা কুকুরটা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। তারপর মরা কুকুর চুরির কারণ জানিয়ে তিনি কুকুরের মাংস পুড়িয়ে খেয়ে নেন। এই দেখে চন্ডালরা আশ্চর্য হয়েছিলেন। ক্ষিধের চোটে মানুষ এক অপরকে মেরে খেয়ে ফেলেছেন। এই গল্পও আছে। স্বর্গচ্যূত ব্যক্তিরা নরকে এসে হাড়গিলে পাখি ও শেয়ালের মাংস খেতেন।
নরমাংস ভোজনের কাহিনীরও মহাভারতে ছড়াছড়ি। একবার স্বয়ং বিধাতা ব্রাহ্মণ সেজে উশীনরের পুত্র শিবির কাছে তাঁর বৃহদর্ভ নামক পুত্রকে খেতে চেয়েছিলেন। রাক্ষসরা তো মানুষ মেরে খেতেনই। মানুষও মানুষ মেরে খেতেন। রাজা কল্মাষপাদ ছিলেন ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা। একবার তিনি মৃগয়া সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। রাজাকে দেখে সেই ব্রাহ্মণ অযথা মাংস ভাত খাওয়ার বায়না ধরলেন। রাজাও ব্রাহ্মণকে মাংস ভাত খাওয়ানোর কথায় রাজি হয়ে গেলেন। রাজা ব্রাহ্মণকে অপেক্ষা করতে বলে রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়লেন। ওদিকে ব্রাহ্মণ ঠায় বসে আছেন। রাজা অন্দরমহলে ঢুকে ভুলে গেছেন ব্রাহ্মণের কথা। যখন মনে পড়ল থখন মাঝরাত। চাকরকে ডেকে রাজা আদেশ দিলেন এক্ষুণি সেই ব্রাহ্মণকে মাংস ভাত পাঠানো হোক। চাকরটি হেঁসেলে ঢুকে দেখে মাংস ভাত বাড়ন্ত। সবটুকুই খাওয়া হয়ে গেছে। রাজা বললেন ব্রাহ্মণ যেন রাতে উপবাস না থেকে যান। মাংস ভাত রান্না করেও যেন ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হয়। চাকর দৌড়োল বধ্যভূমিতে। মানুষ ধরে এনে তাকে কেটে সেই মাংস রান্না করে অন্ন সহযোগে ব্রাহ্মণকে খাওয়ানো হল মাঝরাতে। উক্ত ভোজনপ্রার্থী ব্রাহ্মণের চেয়ে অনেক নামীদামী ব্রহ্মর্ষি ও মহর্ষিরা মানুষের মাংস খেলেও জনৈক ব্রাহ্মণ নরমাংস মুখে দিলেন না। রেগেমেগে তিনি রাজা কল্মাষপাদকে অভিশাপ দিলেন। সেই অভিশাপের জেরে কল্মাষপাদের নরমাংস ভক্ষণের লিপ্সা জাগে। বলা হয় রাজা কল্মাষপাদ প্রথমে বশিষ্ঠের বড়ছেলে শক্ত্রিকে খেয়েছিলেন। তারপর তিনি বশিষ্ঠের অন্যান্য পুত্রদেরও ভক্ষণ করেছিলেন। পৌরাণিক কবিরা কিছু না পেয়ে অনেক সময়ে মানুষের মাংস রান্না করিয়ে দিলেও অনেকে অভোজ্য হিসেবে তা আর মুখে দেননি।
একবার বশিষ্ঠ, অত্রি, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, বিশ্বামিত্র ও কশ্যপ নামের সাত মহর্ষি ও দেবী অরুন্ধতী ব্রহ্মলোকপ্রাপ্তির জন্যে ঘোর তপস্যা করছিলেন। ব্রহ্মলোক খুঁজতে তাঁদের সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করতে হয়েছিল। কোন এক জায়গায় তখন অনাবৃষ্টি চলছিল। সপ্তর্ষিদের সঙ্গে রাজা শৈব্যের এক ছেলেও পৃথিবী পর্যটন করছিলেন। রাজা শৈব্য যজ্ঞানুষ্ঠান করে ওই পুত্রকে দান করেছিলেন তাঁদের হাতে। অনাবৃষ্টির অঞ্চল দিয়ে যেতে যেতে শৈব্যকুমার মারা যান। তখন দুর্ভিক্ষ। খাবার পাওয়া যাচ্ছেনা। সপ্তর্ষিগণ তখন শৈব্যকুমারের মৃতদেহ রান্না করে খেয়েছিলেন। তাঁদের এই করুণ অবস্থা দেখে ও অভোজ্য খেতে হল দেখে রাজা শৈব্য রোজ তাঁদের জন্যে ডুমুর পাঠাতেন। সপ্তর্ষিগণ যা পেতেন তাই খেতেন। একবার তাঁরা এক রমণীয় বনের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে এক অপরূপ সরোবরের কাছে এসে দেখলেন ব্রহ্মসর নামের এক সরোবরে প্রচুর পদ্মফুল ফুটে আছে। সপ্তর্ষিরা জলে নেমে পদ্মফুল ও পদ্মডাঁটা খেয়ে ফেললেন। পরে এই সরোবরে অনেক মুনি ও ঋষি এসে পদ্মের ডাঁটা চিবিয়ে গেছেন। যে সব মহর্ষি নরমাংস, কুকুরের পচা মাংস ইত্যাদি খেয়ে ফেলতে পারেন তাঁরা সাপ, বেজি, ব্যাং, গিরগিটি, শামুক ইত্যাদিও যে ধরে খেতেন তা অনুমান করা যেতেই পারে। তবে বর্ণনা পাওয়া যায়না।
একবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য নরমাংস ভক্ষণ করেছিলেন। দৈত্যরা বৃহস্পতির পুত্র কচকে কেটেকুটে, পুড়িয়ে মদের সঙ্গে গুলে শুক্রাচার্যকে পান করতে দিয়েছিলেন। একবার অগস্ত্য মুনি দানবের মাংস খেয়েছিলেন। ইল্বল আর বাতাপি দুই ভাই। দনুর ছেলে। তাই তারা দানব। ইল্বল আর বাতাপি নরহত্যা করতে ভালবাসতেন। বাতাপি ছাগলের রুপ ধারণ করতেন। ইল্বল সেই ছাগলের মাংস অতিথিদের খেতে দিতেন। অতিথি পেট পুরে মাংস খেলে ইল্বল বাতাপির নাম ধরে জোরে হাঁক পাড়লেই অতিথির পেট চিড়ে বাতাপি বেরিয়ে আসতেন। অতিথি মারা যেতেন। অগস্ত্য মুনিকে একবার অতিথি করতে পেরে ইল্বল তাঁকে বাতাপির মাংস খাইয়েছিলেন। অগস্ত্য জেনে বুঝেই বাতাপির মাংস খেয়েছিলেন।