“হে সর্বজ্ঞানাধিপতি পন্ডিত হুতোম, অদ্য আপনি আমাদিগের সভাস্থলে সমুপস্থিত হইয়া চক্রান্তাসুর চরিত্র বর্ণনা করিয়া আমাদিগকে জ্ঞানলব্ধ করুন। কি কারণে মহারাণী চক্রান্তাসুরের ভয়ে ভীত থাকিলেও প্রজাগণের নিকট তিনি কৌতুকোপাদান হইয়াছিলেন?” যেমন বিন্দুসম জলরাশি একত্রিত হইয়া সিন্ধুরূপ ধারণ করে তদ্রূপ কিঞ্চিত জ্ঞানাহরণ করিয়া জ্ঞানসিন্ধু আখ্যায়িত হইবার অভিপ্রায়ে রাজা জনার্দন করদ্বয় মুখগহ্বরে সঞ্চালিত করিয়া হুটাহুট নাম্নী বিচিত্র শব্দবাণ নিক্ষেপ করিয়া নিমন্ত্রণবার্তা প্রেরণ করিলে সভাস্থল উদ্বেলিত করিয়া সর্বলোকজ্ঞামী মহাবতার হুতোম পন্ডিত আবির্ভূত হইলেন।
“পুরাকালে বঙ্গবর্ষে মহারাণী মমতার রাজত্বকালে প্রজাগণের দুঃখের অন্ত ছিলনা। ইহা সর্ববিদিত হইয়াছিল। চক্রান্তাসুর নাম্নী এক অশুভ আত্মা রাজ্যকে গ্রাস করিয়াছিল। উক্ত আত্মা মহারাণীর হৃদয়গহ্বরে সযত্নে লালিত হইয়া তাঁহাকে কলুষিত করিয়াছিল। মহারাণী স্বপনে শয়নে চক্রান্তাসুরের ভয়ে ভীত থাকিতেন তথা সর্বদা উক্ত অসুরের নামকীর্তন করিতেন। সেই সময়ে ‘সাজানো’ নাম্নী অপর একটি অশুভ আত্মা বিরাজ করিত। কোনরূপ দুর্ঘটনা ঘটিলে ‘সাজানো’র উপর দোষারোপ করা হইত। কথিত আছে চক্রান্তাসুর এবং সাজানো নামক দুটি অশুভ আত্মা দীর্ঘকাল মহারাণীকে গ্রাস করিয়াছিল। তথাপি প্রজাগণ চক্রান্তাসুরের ভয়ে ভীত হইতেন না। প্রজাগণের নিকট চক্রান্তাসুর আমোদচরিত্ররূপে উপস্থাপিত হইয়াছিল। সাজানো নামক অসুরচরিত্রটিও প্রজাগণের কৌতুকোপাদান হিসেবে পরিগণিত হইত। সর্বোপরি মহারাণীর দুই স্কন্ধে চক্রান্তাসুর ও সাজানো উপস্থাপিত হইলে প্রজাগণ মহারাণীকে লইয়া যারপরনাই কৌতুকক্রীড়ায় মত্ত হইতেন।”
“কথিত আছে মহারাণী মমতা চক্রান্তাসুরকে জপ ও তপস্যাদ্বারা তুষ্ট করিয়া ক্ষণকাল বঙ্গবর্ষের সিংহাসনাসীন হইয়াছিলেন। কথিত হইত চক্রান্তাসুরসহ বিবিধ বঙ্গবিভূতিবৃন্দ এবং দশরঙ্গীসৈন্য সমভিব্যাহারে সিপিএম নাম্নী জনৈক প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে নির্বাচনযুদ্ধে পরাস্ত করিয়া মহারাণী মমতা বঙ্গবর্ষ অধিকার করিয়াছিলেন। রাজ্যাভিষেকের ক্ষণকাল গত হইলে তিনি চক্রান্তাসুরের সুশিষ্য কোটেশ্বরকে স্বীয় সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে ছলে ও কৌশলে হত্যা করিলে চক্রান্তাসুর ক্ষিপ্ত হইয়া মহারাণীকে অভিশাপ প্রদান করিলে তিনি শয়নে ও স্বপনে চক্রান্তাসুর অবলোকন করিয়া তাহার ভয়ে ভীত থাকিতেন। প্রজাগণ আমোদপূর্বক কহিত চক্রান্তাসুরের প্রকোপে বঙ্গবর্ষে ভূমিকম্প ও বন্যার আবির্ভাব হইয়াছিল। প্রজাগণ কৌতুকচ্ছলে কহিত, সূর্যের তেজের প্রাবল্যও চক্রান্তাসুরের প্রভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছিল। চক্রান্তাসুরের অভিশাপেই মহারাণী মমতার মতিভ্রম হইয়াছিল।”
“মহারাণীর পারিষদবর্গও চক্রান্তাসুরের ভজনা করিত। যেমন গুণীজন প্রত্যহ সূর্যবন্দনাদ্বারা প্রাত্যহিক কার্যাদি প্রারম্ভ করিত তদ্রূপ দুরাত্মাগণ চক্রান্তাসুরের তপস্যা করিয়া দিনযাপন করিত। চক্রান্তাসুরের প্রকোপে সেইকালে বঙ্গললনাদিগের শ্লীলতাহানি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বঙ্গবর্ষ পাপাগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হইল। দুরাত্মা এবং পাপাত্মাবর্গের আস্ফালন ও দুরাচার বৃদ্ধি পাইল তথা চক্রান্তাসুরের প্রভাবে পাপকর্ম লুক্কায়িত হইতে থাকিল। যেমন গন্ধ এবং রূপদ্বারা পুষ্পরাজি চিহ্নিত হয় তদ্রূপ ধর্ষণ, পাপাচার, হত্যা এবং চৌর্য্যাদি জনমানসে বঙ্গবর্ষকে চিহ্নিত করিত।”
“হে রাজা জনার্দন, চক্রান্তাসুরের প্রাবল্য পরিলক্ষিত হইলে প্রজাগণের দুঃখমন্ডিত জীবনযাপনের কালভাগেও তাঁহারা চক্রান্তাসুর সহ মহারাণী মমতাকে কৌতুকোপাদান পরিলক্ষিত করিয়া সহাস্যে কষ্টলাঘব করিত.” এইরূপ বর্ণনা করিয়া রাজা জনার্দন কর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া বায়ুজাল কম্পান্বিত করিয়া হুতোম পন্ডিত স্বীয় পক্ষবিস্তারপূর্বক মহাকাশদিশায় বিলীন হইলেন। রাজা জনার্দন তাঁহাকে সাধুবাদ জ্ঞাপনান্তে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম জানাইয়া সভাভঙ্গ করিলেন।