যে দল মা মাটি মানুষের রাজনীতি করে সেই দল ধর্মঘটের এরকম নগ্ন বিরোধিতা করছে কেন? সরাসরি সরকারি বিরোধিতা হাস্যকর। কিন্তু ভয়ঙ্কর। ভারতে কোন সরকার ধর্মঘটের বিপক্ষে উস্কানিমূলক বিরোধিতা করতে সাহস করছেনা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতার সরকার তেড়েফুঁড়ে রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ছেড়ে গত সাতদিন ধরে ধর্মঘটের বিরোধিতা করতে আদাজল খেয়ে রাস্তায় নেমেছিল। সর্বভারতীয় শ্রমিক ধর্মঘট সফল হতে চলেছে এই কথা ধর্মঘট শুরু হওয়ার আগেই বলা হয়েছিল। সমস্ত সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন এবং বিভিন্ন ফেডারেশনের সংযুক্ত আহ্বানের ২৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট সফল হল। তবে মমতার ছেলেমানুষির অর্থ কি?
এতগুলি শ্রমিক সংগঠন এক মঞ্চে কোনদিন হয়নি। একসঙ্গে লড়াইও কোনদিন করেনি। কেন্দ্র সরকারের মনিবতোষণ নীতির বিরোধিতা করতে শাসক দলগুলির শ্রমিক সংগঠনগুলিও ধর্মঘটে শামিল হয়েছে। শ্রম আইনের তোয়াক্কা করছেনা বহুজাতিক সংস্থাগুলি। তার দোসর হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্থাগুলিও। সরকারের চোখ বন্ধ। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। অথচ অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্যে ন্যুনতম ভাতা বাড়ার নামগন্ধ নেই। শ্রমিক ও কর্মচারীদের সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। পেনশন ফান্ডও কায়দা করে ফাটকা বাজারে ঢেলে ন্যুনতম সুরক্ষিত জমানো টাকা অসংরক্ষিত করে ফেলা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে ফেলার জন্যে বিকেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে। স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মচারী কমিয়ে ফেলে ঠেকা শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। যাদের সামাজিক সুরক্ষা নৈব নৈব চ। এইসব কারণগুলি ভারতের প্রায় সমস্ত শ্রমিক ও কর্মচারীদের ইউনিয়নকে এক ছাতের তলায় বসে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। কিন্তু মমতার ধর্মঘট বিরোধিতার অর্থ কি? ধর্মঘট ডেকেছিল ট্রেড ইউনিয়নগুলি। তাতে একটি রাজনৈতিক দলের এত মাথাব্যথার কারণ কি? মমতার বিরুদ্ধে তো এই ধর্মঘট ছিলনা!
গত পনের দিনের মধ্যে বেশ কিছু খবর পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সম্ভাবনার ওপর জল ঢেলে দিয়েছে। ভূষণ স্টিল জমি জোগাড় করতে না পেরে এই রাজ্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারপর জয় বালাজি স্টিল কোম্পানিও রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আধুনিক ও শ্যাম স্টিলের ইস্পাত প্রকল্প বিশ বাঁও জলে। এছাড়া আছে জাহাজ তৈরির প্রকল্প। সিমেন্ট, বিদ্যুৎ, রেল সরঞ্জাম তৈরির প্রকল্প। এইসব প্রকল্পগুলির ভবিষ্যত অন্ধকার।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপতিদের কর্ণাটক সরকার ডাকছে। পশ্চিমবঙ্গে জমির জট ছাড়ানো যাচ্ছেনা তার ওপর নৈরাজ্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অন্যান্য রাজ্যের ডাকে এই রাজ্যের শিল্পপতিরাও সাড়া দিতে পারে। এইসব দেখে মমতার মাথায় বাজ পড়েছে। শিরে সংক্রান্তির অবস্থা। তাই ধর্মঘটের বিরোধিতা করে শিল্পপতিদের বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে ‘কর্ম সংস্কৃতি’ ফেরানোর জন্যে তিনি বদ্ধ পরিকর। ধর্মঘটও তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন। তাই গত সাতদিন ধরে মাথার ঘাম আঁচলে ফেলে সবরকম সরকারি কাজ শিকেয় তুলে সব মন্ত্রীদের রাস্তায় নামিয়ে ধর্মঘটেই নাক গলিয়ে ফেলেছেন।
খামখেয়ালি মুখ্যমন্ত্রী। যেহেতু বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি কিংবা সিপিআইএম এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছে তাই আস্ফালন তো তৃণমূলী রাজনৈতিক দলটিকে দিতেই হবে। ধর্মঘটীদের চাকরি খোয়ানোর হুমকি দিতে হবে। লোক চড়ুক চাই না চড়ুক বাস ট্রাম ট্যাক্সি চালাতে হবে। শিল্পপতিদের দেখাতে হবে এরাজ্যে আর ‘বন্ধ’ হয়না। বন্ধের বিরুদ্ধে ‘চাকা’ ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে।
দু’দিনের খবর পড়লে বোঝা যায়, মমতা কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ‘বন্ধ রাজনীতি’ চালিয়ে এসেছেন তার ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন। শিল্পপতিদের খুশি করতেই তিনি এইসব খামখেয়ালিপনা করছেন তা না বললেও বোঝা যায়। আজ তিনি আবার বলেছেন ‘কর্পোরেট লবি’ নাকি তাঁর ওপর বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে। তাই সংবাদমাধ্যম তাঁকে নিয়ে বিদ্রূপ করছে। শ্রমিক ও কর্মচারীদের ধর্মঘটের আগুনে তিনি হাত দিয়েছিলেন। হাত পুড়ল। আরও বেশি করে হাত দিলে আগুনের আঁচ আরও বাড়বে। সেই আগুনে তাঁর মুখ পুড়তে পারে। তখন বলবেন হয়তো শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিরোধিতা না করাই তাঁর ঠিক হত। ধর্মঘটের বিরোধিতা করে তিনি ভুল করেছিলেন।