পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার সাংবাদিকদের হুমকি দিলেন। এর আগে তাঁর সমালোচকদের তিনি ‘কুত্তা’ বলেছিলেন। বেশ কয়েকবার সাংবাদিকরা তাঁর কাছে ধমক খেয়েছেন। তাঁর অনুগত সুব্রত বক্সী মহাকরণে বসে সাংবাদিকদের ‘দেখে নেব’ বলে শাসিয়েছেন। স্বৈরাচারীরা যখন শাসন করে তখন তাদের সমালোচকদের এবং সাংবাদিকদের গালমন্দ খেতে হবেই। গণতন্ত্রের গলা টিপে মারার ছক কষে তৃণভোজী দলটির সুপ্রিমো এখন কথায় কথায় সাংবাদিকদের ওপর চোটপাট করছেন। আটমাসের মধ্যে তাঁর দলের ছোট বড় নেতারা সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, হয় আমাদের হয়ে কথা বল। নয়তো কাজ ছাড়ো।
সাংবাদিকদের দোষ নেই। অনেক চেপেচুপে যা ওঁরা লিখছেন তার মধ্যেই বর্তমান রাজ্য সরকারের জীর্ণ দশা ভেসে উঠছে। শিশু মৃত্যু বেড়েই চলেছে। সাংবাদিকরা লিখবেন কি করে যে শিশু মৃত্যু কমে গেছে! এক সঙ্গে এতগুলি শিশুর একই হাসপাতালে মৃত্যু সন্দেহ জাগায়। কাজের গাফিলতি শিশুমৃত্যুর জন্যে দায়ী। এর জন্যে দায়ী ওপর মহলের উদাসীনতা। এর জন্যে দায়ী নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা। সাংবাদিকরা কে দায়ী সে কথা বুঝতে পেরেও বলছেন না। শুধু খবর তৈরি করছেন। শুধু তাঁরা বলছেন অমুক হাসপাতালে তমুক দিনে এত ঘন্টার মধ্যে এত শিশু মারা গেল। এতে কোন সমালোচনা নেই। এতে হলুদ সাংবাদিকতাও নেই। নির্ভেজাল সত্যি কথাই বর্তমান সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠছে।
হাসপাতাল থেকে গর্ভবতীকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তায় প্রসব করে মারা গেলেন কেউ। কোন গর্ভবতীকে বলে দেওয়া হলে এক মাস পরে হাসপাতালে আসতে। অথচ ওই দিনই সেই গর্ভবতী একটি সন্তানের জন্ম দিলেন। তাও রাস্তার ধারে। এবং হাসপাতাল থেকে বাড়ি মুখো হওয়ার দু তিন ঘন্টার মধ্যে। সংবাদ যদি লুকিয়ে রাখা যেত তবে হয়ত মমতা খুশি থাকতেন। কিন্তু সংবাদকে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। তাই সংবাদ লুকিয়ে ফেললে সংবাদপত্রের ওপর সন্দেহ হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সংবাদ প্রকাশ করতে হয়। মমতার রাগ হওয়া উচিত সংবাদমাধ্যমের ওপর। সাংবাদিকদের ওপর রাগ করছেন কেন? যারা রিপোর্টার তাঁরা তো শুধু সংবাদ সংগ্রহ করে ছাপাখানায় পৌঁছে দিচ্ছেন। খবর ছাপা হচ্ছে কেন? কার দোষ? কিছু সাংবাদিক আছেন যারা সম্পাদকীয় এবং উত্তর সম্পাদকীয় লেখেন। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম ওই সব স্থান থেকে মমতার প্রশংসা করেই চলেছেন। এমনকি একটি সংবাদপত্রের মালিক মমতার ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ মার্কা সন্দেহ কে সত্য বলে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর কাগজের সম্পাদকীয়তে। তবে মমতার এত রাগ কেন?
ইদানীং কৃষক আত্মহত্যার খবরটি আর চাপা পড়ে থাকতে পারছেনা। তাই সব সাংবাদিককেই ওই খবর সংগ্রহ করার জন্যে ছুটতে হচ্ছে কৃষকের বাড়ি। দেখতে যেতে হচ্ছে সত্যিই ওটা ফসলের দাম না পেয়ে দেনার দায়ে আত্মহত্যা, নাকি ‘প্রেমঘটিত’ রোগে পড়ে আত্মহত্যা! সাংবাদিকরা এসে কাগজগুলিতে লিখছেন মৃত কৃষকের পরিজনদের ভাষ্য। দেখে আসছেন গোলা ভরা ধান। শুনে আসছেন মহাজনদের কাছে তাদের কত দেনা। উপলব্ধি করে আসছেন সরকার ঠিকঠাক বন্দোবস্ত করতে পারেনি। তাই ফসলের দাম পাওয়া যায়নি। যদি এই সরকার বিরোধী কয়েকটি কাগজ না থাকত তবে এই সব খবর মৃতের সঙ্গেই মাটির তলায় চাপা পড়ত। জলে ধুয়ে ফেলা যেত। কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে তা হচ্ছে না। কিছু কাগজ এখনও টিকে আছে। তারা সরকার বিরোধী কথা লিখে চলেছে। মানুষের খবর দিয়ে চলেছে। এতেই রেগে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাই মমতার প্রচার করতে যে সব সংবাদপত্রগুলি ছাপা হয় তাতেও টুকটাক কথা লিখে দিতে হয়। এতে ‘হলুদ’ লাগান যাচ্ছেনা।
মমতা তথ্য প্রমাণের ধার ধারেননা। অযৌক্তিক কথা বলতে তিনি সিদ্ধহস্ত। কৃষক আত্মহত্যা নিয়ে তিনি বললেন, “‘যারা আত্মহত্যা করেছেন, তাদের মধ্যে বারোজন পার্সোনাল রোগে মারা গেছেন। কেউ কেউ কোটি কোটি টাকা পার্সোনাল লোন করেছিলেন। কোনও কৃষিজমির সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল না। যা বলা হচ্ছে, অসত্য সব কথা।”
এই সব অসত্য কথা সাংবাদিকরা লিখছেন কেন? মমতার রাগ হওয়া স্বাভাবিক। তিনি যে দিনরাত এই রাজ্যের উন্নতির জন্যে খেটে চলেছেন সেই কথা নাকি সাংবাদিকরা লিখছেন না। সাংবাদিকদের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাঁর খাটাখাটনির পূঙ্খানুপূংখ বিবরণ না দিয়ে ছোটখাট বিষয়ে নিয়ে সাংবাদিকরা লিখছেন বলে রাগ হচ্ছে। অর্থাৎ তাঁর প্রচার না করে বিভিন্ন ছোট বড় খবর ছাপা হচ্ছে বলে তাঁর রাগ বেড়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ না পেয়ে যদি তাঁর ভজনা করা হয় তবে তিনি খুশি থাকবেন। কিন্তু তাঁকে কে বোঝাবে যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সংবাদপত্রকে ভুরিভুরি অসত্যের মধ্যেও ছোট করে কিছু সত্য কথা লিখতেই হচ্ছে। নইলে মানুষ ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে যাবে যে। নইলে তাঁর ভজগান করার জন্যে ছাপা বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের বিক্রি কমে যেতে পারে। ছোট করে এই সব সত্য সংবাদ প্রকাশ না করলে নিরপেক্ষতা ও তাঁবেদারির অর্থ উলটে যেতে পারে।
কিন্তু এবার সতর্ক থাকতে হবে সাংবাদিকদের। তৃণভোজী দলটি দুষ্কৃতীতে ভরা। যে কোন জায়গায় যে কোন সাংবাদিকের ওপর ওদের আক্রমণ বাড়তে পারে। কারণ মমতা ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন সাংবাদিকদের অসত্য কথার জবাব তৃণভোজীদেরই দিতে হবে। কি জবাব তারা দিতে জানে তার সাক্ষী ইতিহাস। সাংবাদিকরা সাবধান থাকুন।