বিশ্বায়নের যুগে কেনাবেচার ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে গেছে। সবকিছুই বিক্রি হয়। যা বিক্রি হয় তা কেনাও যায়। তার মানে সবকিছুই কেনা যায়। আগে ঘাট মাঠ বিক্রি হত। এখন রাস্তা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। টোল ট্যাক্স দিয়ে রাস্তা চলতে হচ্ছে। বন জঙ্গল বিক্রি হচ্ছে। ট্যাঁকে কড়ি থাকলে বাড়ি, গাড়ি কেন চাঁদ পর্যন্ত কিনে ফেলা যায়। কয়লা, বীমা, তেল, রেল, ভেল এসব নিয়ে অনেককাল ধরেই ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছিল। এখন আর রাখঢাকের বালাই নেই। লজ্জার মাথা খেয়ে এসব বিক্রির বহর লেগেছে। থরে থরে সাজানো আছে। ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর! দেশজ ব্যাবসাদার ফেলুক। কিংবা বিদেশি হামলাদার। কেউ আজ আর পর নয়।
বিশ্বায়নের যুগে মিডিয়া বিক্রি হয়ে গেছে। ওরা কড়ি না দিলে বাজনা বাজায় না। যার কাছ থেকে টাকা পাবে তার জন্যেই গাইবে। সে পদার্থ কিংবা অপদার্থ হোক। অর্থের অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে পারলে ‘হয়’কে নয় করে দিতে পারে ওরা। ‘নয়’কে আবার ছয় করতেও সিদ্ধহস্ত। এইভাবেই সমাজটাকে নয়ছয় করে দিচ্ছে বিশ্বায়নের কেনাবেচার বাজারটা। শিক্ষা বিক্রি হয়ে গেছে। পয়সা না থাকলে শিক্ষা মেলা ভার। শিক্ষক বিক্রি হয়ে গেছে। ভাল শিক্ষকের কাছে বেশি পয়সা দিয়ে টিউশন পড়তে হচ্ছে। স্বাস্থ্য, খাদ্য এসবতো কোন কালেই ‘ফিরি’তে পাওয়া যায়নি। হরেকরম ফেরিওয়ালা এসব পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। দামে পোষালে কিনেও ফেলা যায়।
এই যুগে বিচারকেও পণ্য বলে গণ্য করা হচ্ছে। ভাল উকিলকে ভাড়া করে কিনলেই এমন অনেক কেস আছে যা উকিলের কেরামতিতেই গুবলেট হয়ে যায়। আইন আইনের পথে চলে। আর উকিল এসে কায়দা করে আইনের অমলেট বানিয়ে দেয়। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে ককিয়ে একসার। পীড়িত মানুষ সাজা পায়। আসামী মজা পায়। এরকম হয়েই আসছে। বিচারক বিক্রি হয় বলেও শোনা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা সংবেদনশীল। আমি বিচারক বিক্রি হতে নিজের চোখে দেখিনি। আর শোনা কথায় আমি বিশ্বাস করিনা। চাপরাশি, কনস্টেবল, কেরানি, দারোগা, অফিসার সবাই বিক্রি হয়। ন্যায্য দাম পেলেই হল।
আমি এক নেট ঘেঁটো বাঙালি। আজ ‘হিউম্যান ট্র্যাফিকিং’ ঘাঁটছিলাম। দেখলাম মানুষ বিক্রি হয়। এটা প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে আসছে। আগে আফ্রিকা থেকে কালো মানুষ ইউরোপে নিয়ে আসা হত। সেখান থেকে অনেক জায়গায় চালান করা হত। এখন এটা বন্ধ আছে। এখন তৃতীয় বিশ্বের মেয়েদের কেনাবেচা করে অন্ধকার জগতে চালান করে দেওয়া হচ্ছে। নয়তো ঝি’গিরির চাকরি দেওয়া হচ্ছে। ছেলেদের বেলাতেও তাই। বেগার খাটানোর জন্যে এখনও কিনে রাখা হচ্ছে। শিশু কেনাবেচা হচ্ছে। জামাই কেনাবেচা চলছে। এমনকি মেধাবী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের কিনতে কোম্পানিগুলো ভাল টাকা খরচ করছে।
ভারতে অদ্ভুত ধরণের ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’ হচ্ছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘হর্স ট্রেডিং’। তার মানে গোরু ছাগল কেনাবেচার মতো আমাদের দেশে নেতা কেনাবেচা চলছে। পঞ্চায়েত সদস্য আর পৌরসভার কাউন্সিলার কেনা যাচ্ছে। সংসদে টাকা উড়তে দেখা গেছে। সাংসদ কিনে দেশ চলতে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিধায়কের গুষ্টি কিনে রাজ্যের ষষ্ঠীপুজো করতে দেখা গেছে। সব মিলিয়ে বিশ্বায়নের বাজারি অর্থনীতি মানুষের চেতনার ওপর জাঁকিয়ে বসেছে। মানুষ এসব মেনে নিয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে ভারতে এই ধরণের ‘হিউম্যান ট্র্যাফিকিং’ মনুষ্যত্বের টুঁটি চিপে ধরেছে।
PC: seppo।net