Flickr Gallery

Sunday, March 11, 2012

পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদীরা শীতঘুমে গেলেন



ভারতের মাওবাদীদের বিচরণক্ষেত্র রেড করিডর বলতে মূলত অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, উড়িষ্যা, বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ জেলা অনুন্নত। অনুন্নয়নের সুযোগ নিয়ে এই অঞ্চলে মাওবাদীদের সংগঠন বিস্তার করতে সুবিধা হয়েছে। বলাবাহুল্য পশ্চিমবঙ্গের মোট উনিশটি জেলার মধ্যে কেবল তিনটি জেলা রেড করিডরের আওতায় আসে। উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড়ের অর্ধেকের বেশি সংখ্যক জেলা মাওবাদীদের রেড করিডর। ঝাড়খন্ডের প্রায় সব জেলাই মাওবাদী অধ্যুষিত। এই রাজ্যে মোট চব্বিশটি জেলার মধ্যে আঠারটি জেলা রেড করিডরের আওতায় পড়ে।

তুলনামূলকভাবে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের দৌরাত্ম্য কম। কিন্তু পরিকল্পনাগতভাবে পশ্চিমবঙ্গেই মাওবাদীরা নন্দীগ্রামের ‘লড়াই’ করে সারা ভারতে আলোড়ন তুলেছিল। এই কথা মাওবাদীদের নথিতে পাওয়া যায়। এইরকম আলোড়ন ভারতীয় মাওবাদী ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীর সমস্ত সংবাদমাধ্যমে সরকারের পুলিশের সাধারণ গ্রামবাসীদের ওপর গুলিবর্ষণ এবং ‘গণহত্যা’র খবর প্রাধান্য পেয়েছিল। মাওবাদীরা এখানে শ্রীলঙ্কার জঙ্গি সংগঠন ‘টাইগার’দের কায়দায় সরকারি পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। শিশু ও নারীদের সামনে রেখে তারা বন্দুকধারীদের পেছনের সারিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও নারী ও শিশুকে ঢাল বানিয়ে মাওবাদীদের আড়াল করে দিয়েছিল। 

রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট হয়ে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী দৌরাত্ম্য বেড়েছিল। বুদ্ধিজীবিদের একাংশ এঁদের সমর্থনে কৌঁশুলি করতেন। বর্তমান শাসকদলের সঙ্গে মাওবাদীরা এখনো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই রাজ্যে সম্প্রতি যে সকল মাওবাদী ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন তাঁদের নাটকীয় সমর্পণে শাসকদলের সপক্ষে দাঁড়ানো বুদ্ধিজীবিরা আজকাল প্রতিটি সমর্পণের নাটকে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। শাসকদলের বেশ কয়েকজন বিধায়ক এবং সাংসদও মাওবাদীদের খোলস খুলে রাখতে সাহায্য করছেন। 

শোনা যেত মমতা মুখ্যমন্ত্রী হলে ‘জনগণ’ খুশি হবেন। জনগণ খুশি আছেন এখন। খুন হত্যা সহ বিভিন্ন অপরাধিক মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে ‘জনগণ’কে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। ‘জনগণ’ আত্মসমর্পণ করলে বিভিন্নভাবে তাদের সামাজিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ‘জনগণ’ আকাশ, ‘জনগণ’ বিকাশ এবং আরও অনেকে নেপথ্যে রয়েছেন। এঁরা ক্রমশ প্রকাশ্য। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে এঁরা ‘সামাজিক ও সুস্থ’ জীবনযাপনের জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় রশদ পেয়ে যাবেন। বাম আমলে বাম কর্মী, সমর্থক ও দক্ষ সংগঠকদের হত্যা করার পুরস্কারস্বরূপ এদের সাত খুন মাফ করে দেওয়া হবে। ‘জনগণ’ খুশি হবেন। বাম আমল পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এঁদের হত্যালীলাকে পুনরায় প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যেই এঁদের ওপর থেকে বিভিন্ন অপরাধিক মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা আলোচনা করা হচ্ছে। ‘জনগণ’কে পুরস্কৃত হতে দেখে কবীর সুমন খুশি থাকবেন। মহাশ্বেতা দেবীও খুশি হবেন। বাংলার ‘বুদ্ধিজীবি’রা আনন্দে চার হাত তুলে খুশিতে জঙ্গলমহলে ডিগবাজি খাবেন। 

তবে কি পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাওবাদীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? ২০০৪ সালের একটি মাওবাদী নথিতে ‘বিপ্লব’ আনার লক্ষ্যে নতুন রেড করিডর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা, মূলত পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বর্তমান শাসকদল যখন বিরোধী আসনে ছিল তখন এঁরা এই তিন রাজ্যেই রেড করিডর বিস্তার করতে প্রশ্রয় পেয়েছে। ‘মাও ফাও বলে কিছু নেই’ বলে এদের উপস্থিতি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন সেই ‘মাও’রা আত্মসমর্পণ করে আইনের সংরক্ষণে এসে নির্ভয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবেন। এঁরাই শাসকদলের হয়ে প্রকাশ্যে বা গোপনে কাজ করবেন। শাসকদল আবার যখন বিরোধী আসনে বসবে তখন এঁরাই আবার আস্তিন গুটিয়ে ‘বিপ্লব’ এনে রেড করিডর বাঁচাতে তৎপর হবেন। শাসক দলের সঙ্গে মিলেমিশে বাম আন্দোলন প্রতিহত করার লক্ষ্যেই এঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আত্মসমর্পণ’ করে চলেছেন। পৌরাণিক গল্পের কৃষ্ণ ও সুদামার বন্ধুত্ব অটুট ছিল। এখানেও বর্তমান শাসকদলের সঙ্গে মাওবাদীদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। শুধু ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মসমর্পণের সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করতে হয়েছে। শীতের শুরুতে যেমন সর্পকূল শীতঘুমে চলে যায়, তেমনি ‘পরিবর্তন’এর হাওয়ায় অনেকে এখন ঘুমোতে গেলেন। খোলস ছেড়ে উপযুক্ত আবহাওয়ার বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করতে হবে এখন।
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
বাংলা ব্লগ জগতের সিন্ধুতে আমরাও একটা বিন্দু। নেট ঘেঁটো বাঙালির আপ্যায়ণে বড় হচ্ছে। শৌভিকের লেখা পড়তে এই ব্লগে যান LEKHASHAUBHIK.BLOGSPOT.COM