AMRI Dhakuria |
কলকাতা শহর একেবারে ঘিঞ্জি শহর। ধাপার মাঠ থেকে গঙ্গার ঘাট পর্যন্ত সবটাই মানুষে ভরিয়ে ফেলেছে। শুধু গড়ের মাঠটি এখন পর্যন্ত আস্ত আছে। লন্ডন হয়ে গেলে আর এসব চোখে নাও পড়তে পারে। ঘিঞ্জি শহরের জ্বালা অনেক। যান জটের জ্বালায় প্রাণ জ্বলে। গরমের জ্বালায় গা জ্বলে। ধোঁয়ার জ্বালায় চোখ জ্বলে। ঘিঞ্জি না হলে এই শহরে মানুষকে এইভাবে জ্বলে পুড়ে মরতে হতনা। তাও মানুষ দিব্যি আছে। কিন্তু যতদিন লন্ডন না হচ্ছে ততদিন আগুন লাগলে এই ঘিঞ্জি শহরের মধ্যে দিয়েই দমকলকে ঢিকঢিক করে এগোতে হবে। ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর জন্যে যথেষ্ট গবেষণা করতে হবে। জল কোথায় পাওয়া যাবে তার জন্যেও অনুসন্ধান করতে হবে। এত ঝক্কি সামলানোর পরে কিভাবে আগুন নিভিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায় সেই কথাটিও চিন্তা করতে হবে।
পোড়ার গল্প কোলকাতায় নতুন নয়। এই শহর বইমেলার সব দোকান ও তার সঙ্গে সব বই পুড়িয়ে নিজের মুখ পুড়িয়েছে। হগ মার্কেট পুড়েছে। তোপসিয়া আর তিলজলায় প্রতি বছরই গড়ে তিনটি করে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। চামড়ার ফ্যাক্টরি, রবারের ফ্যাক্টরি, বাজির ফ্যাক্টরি, জুতোর ফ্যাক্টরি, রাসায়নিক দ্রব্য তৈরির ফ্যাক্টরি তো প্রতি বছর পুড়ছে। পুজোর প্যান্ডেল পুড়ছে। পুড়ছে স্কুল বিল্ডিং। বড়বাজারের ত্রিপলপট্টি পুড়ে গেল। স্টিফেন কোর্ট পুড়ে গেল। পোড়ার আর শেষ নেই। আরও পুড়বে। তবে নার্সিং হোম পোড়ার ঘটনা এই প্রথম। এবং ৯০ জন মানুষের জীবনহানি হওয়ার ঘটনাও এই প্রথম। কিন্তু পোড়া নিয়ে তারানন্দের রাজনীতিও এই প্রথম নয়।
তারানন্দের চোখ নোংরা খোঁজে। তখন পুড়লে দমকলের দেরি করে পৌঁছোন হয়ে পড়ত সংবাদ শিরোনাম। এখন পুড়েছে বলে সেটি আর সংবাদ নয়। এখন ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে অন্য কিছু। নার্সিং হোমের মালিক টোডির সঙ্গে জ্যোতি বসুর দহরম মহরমের জন্যেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে নার্সিং হোমটির রমরমা ব্যাবসা। আর নিয়মকে তোয়াক্কা করেনি বলেই নার্সিং হোমটি পুড়েছে। যেন বেসমেন্টে অত দাহ্য পদার্থের আস্তাকুঁড় বানিয়ে রাখার জন্যে দোষী একমাত্র প্রয়াত জ্যোতি বসু। মিউনিসিপ্যালিটি বা কর্পোরেশনের এসব ব্যাপারে চোখ বন্ধ। তার জন্যেও দায়ী জ্যোতি বসু? নার্সিং হোমের প্রবন্ধন ও কর্মচারীরা আগুন লাগার পর জানতে পেরেও পাত্তা দেয়নি। তার দায়ভার বহন করবেন প্রয়াত জ্যোতি বসু। পাড়ার লোক সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলেও নার্সিং হোমের সুরক্ষা কর্মীরা সে আবেদন নাকচ করেছেন। এটিও কি জ্যোতি বসুর দোষ? রুগীদের আত্মীয়স্বজনরাও সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ালেন। কিন্তু সুরক্ষা কর্মী ও অন্যান্য কর্মচারীরা গুরুত্ব না বুঝে সেই আবেদনও নাকচ করে দিলেন। এর দায়ও জ্যোতি বসুর। তারানন্দ মহানন্দে এক তাল কাদা তুলে চারদিকে ছিটিয়ে যাচ্ছে। মৃত রুগীদের তিরিশবার দেখিয়ে ব্যাবসা করছে। রুগীদের আত্মীয়স্বজনকে ক্যামেরার সামনে হাউহাউ করে কাঁদতে দেখাচ্ছে। পাবলিক দেখছে। আহা রে! কি কষ্ট! এরকম কষ্ট যেন শত্রুও না পায়। হায় রে হায়। জীবন বহে যায়।
লন্ডন হচ্ছে না বলেই আগুন লাগলে এই ঘিঞ্জি শহরের মধ্যে দিয়েই টং টং করে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে দমকলকে থেমে থেমেই এগোতে হবে। ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর জন্যে যথেষ্ট গবেষণাও করতে হবে। তারপর জলের খোঁজে মাথা কুটে মরতে হবে। তারপর উৎসুক মানুষের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভেতরে ঢুকে জলের পাইপ বের করতে করতে দুচারটি মানুষের টিকা টিপ্পণি মুখ বুজে সহ্য করতে করতে কাজে হাত লাগাতে হবে। জীবন হাতে নিয়ে কাজ করতে হবে। তারপর তারানন্দ এসে বলত দমকল দেরি করে পৌঁছল কেন? তিন ঘন্টা হয়ে গেল কিন্তু এখনও আগুন নেভানো গেল না কেন? এখন একটু অন্য রকম শুনছে পাবলিক।
আমরি হাসপাতাল পোড়ার পর পাবলিককে এসব শুনতে হয়নি। পাবলিকে এখন টোডির সঙ্গে জ্যোতি বসুর সম্পর্কটি একটু ঝালিয়ে নিচ্ছে। তারানন্দ যদি এখন দমকলের নামে কেচ্ছা গায় তবে নিজের গায়েই থুতু পড়বে। অতএব ভায়া একটু সামলে! আগুন নেভানো কি মামদোবাজি! এতদিনের ফর্মুলা এইবার আর কাজে লাগবেনা। তাই টোডি আর জ্যোতি বসুর সখ্যতা নিয়ে আলিমুদ্দিনে ঢিল মারো। কর্পোরেশনের দায়িত্ব নেই পর্যবেক্ষণ করার। আগুন জ্বলুক। আগুন দেরি করে নিভুক। মানুষ জ্বলে পুড়ে মরুক। জন্ম নিয়েছ যখন ভায়া তখন তো মরতেই হবে একদিন। এ আর নতুন কথা কি। কিন্তু তাই বলে ব্যাবসাটি তো মেরে ফেলতে পারিনা।
আলুর গোদাম পোড়ার পর গোপাল ভাঁড় পোড়া আলু খেতে খেতে গোদামের কর্তাকে বলেছিল, “দাদা, আলুর গোদাম আবার কবে পুড়বে?” চ্যানেলের নাম তারানন্দ। যাহা দেখাইব তাহাতেই আনন্দ। পোড়া আলুর ওপর কামড় বসাতে বসাতে তারানন্দ আকাশের দিকে মুখ তুলে সাতপাঁচ চিন্তা করে আবার বলল, “আলুর গোদাম আবার কবে পুড়বে বলতে পার ভাই?”