খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে ভগবান হুতাশনের কোন বাছবিচার ছিলনা। মহর্ষি ভৃগুর অভিশাপে তিনি সর্বভূক হয়েছিলেন। এমন কোন বস্তু ছিলনা যা অগ্নিদেব আত্মসাৎ করতে পারতেন না। যজ্ঞে যজ্ঞে অগ্নিদেবকে অনেক ঘি খেয়ে বেড়াতে হত। কোন এক যজ্ঞে অগ্নি টানা বারো বছর ঘি খেয়ে কাটিয়েছিলেন। এরপর অগ্নির ক্ষিধের প্রবণতা কমে যায়। যাকে বলে অগ্নিমান্দ্য। অগ্নিদেব ব্রহ্মার কাছে তাঁর সমস্যা জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছিলেন। ব্রহ্মাও এক সমাধানের রাস্তা বাতলে দিলেন। আমাদের হজম না হলে হজমিগুলি খাই। অগ্নিদেবও হজমিগুলির মতোই খান্ডবারণ্য খেতে উদ্যোগ নিলেন। খান্ডবারণ্য খেলেই তাঁর রোগের প্রতিকার হবে এইরূপ কথা স্বয়ং ব্রহ্মাই বলেছিলেন। অগ্নি তাঁর পুরোন খাইখাই রূপে পুনরায় ফিরে আসার জন্যে খান্ডবারণ্যে উপস্থিত হলেন। সেই বনে পান্ডবরাও তখন উপস্থিত ছিলেন। অর্জুনের সহায়তায় তিনি একটানা পনের দিন ধরে খান্ডবারণ্য খেয়ে মুখের স্বাদ বদলান। অগ্নি এই জাতীয় অপরিমিত ভোজন প্রায়শই করতেন।
দেবতাদের খাদ্যতালিকায় একটি পানীয় বরাদ্দ ছিল। সোমরস। দেবতার যার তার সঙ্গে বসে আবার সোমরস খেতেন না। কেউ দেবতাতূল্য কোন কাজকম্ম করলে দেবতারা খাতির করে সম্মান জানিয়ে তাঁকে সোমরস খাওয়াতেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁদের যোগ্যতা বলে দেবতাদের সঙ্গে সোমভাগী হয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা দেবতাদের সঙ্গে এক টেবিলে বলে সোমরস পানের সম্মান অর্জন করেছিলেন। মানুষের পেটে সোমরস সহ্য হত না। কারণ বর্ণিত আছে যদি কোন মানুষ যজ্ঞের মাংসের সাথে সোমরস পান করে ফেলতেন তবে আর তাঁকে খুব বেশিদিন ইহলোকের যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না। রাজা বিশ্বামিত্রকে একবার দেবরাজ ইন্দ্র সোমরস খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিলেন। বিশ্বামিত্র তো সেই রস খেয়ে মাতল হয়ে গেলেন। ধরা কে সরা জ্ঞান করতে লাগলেন। নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে তিনি নিজেকে ব্রহ্মা বলে ভাবতে শুরু করলেন। মাতাল বিশ্বামিত্র ‘আমি ব্রহ্মা হয়ে গেছি, আমি ব্রহ্মা হয়ে গেছি’ বলে চেঁচামিচি লাগিয়ে দেন। সোমরস আর সুরা দু’ধরণের পানীয় ছিল। ব্রাহ্মণদের সোমরস পান করা বিধেয় ছিল। কিন্তু সুরাপান নৈব নৈব চ। অর্থা হুইস্কি খেলে খাওয়া যায় কিন্তু চুল্লু কখনোই নয়। সোমপান তীর্থ বলে একট জায়গার নামও পাওয়া যায়। ইন্দ্রও সোমরস পান করে মাতাল হয়ে যেতেন। একবার তিনি মহারাজ নৃগের যজ্ঞানুষ্ঠানে বা পার্টিতে সোমরস পান করে মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন। মাতাল হোয়ার কাগিনী পুরাণে কম নেই। রৈবতক পর্বতে একবার অন্ধক ও যদুবংশীয়দের এক উৎসবের আয়োজন করা হয়েছি। অর্জুনও উৎসব দেখতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বলরাম মধু খেয়ে মাতাল হয়ে তাঁর স্ত্রী রেবতীকে নিয়ে ঘুরছিলেন। শাম্বও সেখানে মধু খেয়ে মাতলামি করছিলেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়।.
তখনকার কবিরা বলেছেন যে ব্রাহ্মণরা প্রচুর খেতে পারতেন। এক ব্রাহ্মণ একবার দারবরাজ প্রহ্লাদকে বলেছিলেন যে তিনি যদি পেলেন তো প্রচুর পরিমাণে খেয়ে ফেলতে পারেন। আবার কিছু না পেলে দীর্ঘদিন অনাহারেও থাকতে পারেন। সেকালের ব্রাহ্মণদের পায়ে হেঁটে দেশ দেশান্তর ঘুরতে হত। রাঝার কাছে না পৌঁছোতে পারলে খাবারদাবার বিশেষ কিছু জুটতনা। তাই তাঁরা যা পেতেন তাই খেতেন। ঠিক যেন মোটরসাইকেলের ট্যাঙ্কে টইটম্বুর করে পেট্রোল ভরে নেওয়া। চলতেই থাকো। তেন ফুরোতে দেরি আছে। সে ব্রাহ্মণ চালের খুদ, তিলের খোল ইন্ত্যাদি বস্তুকে খাদ্যতালিয়ে রেখেছিলেন। অল্প বা বেশির কোন বাছবিচার ছিলনা। পেলেই খেয়ে নিতেন তিনে।
বদরপাচন তীর্থ বলে এক স্থলের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই তীর্থে যখন অনাবৃষ্টির কাল চলছে, তখন ওখানকার মহর্ষিরা ওই অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার সময়ে সারস্বতের মা সরস্বতী তাঁদের পলায়ন আটকেছিলেন। তিনি নদী থেকে বড় বড় মাছ ধরে খাওয়াতেন। এই স্থলে অরুন্ধতী ‘বদর’ অর্থাৎ কুল রান্না করে অনাবৃষ্টির সময়ে জনগণকে খাওয়াতেন। এই স্থলে যদি কেউ স্রেফ কুল খেয়ে টানা বার বছর কাটাতে পারতেন তবে তাঁকে বশিষ্ঠতূল্য গণ্য করা হত। শাকম্ভরী তীর্থ বলে আরেক জায়গার নাম পাওয়া যায়। সেখানকার দেবীর নাম সুব্রতা। সেই দেবী শুধুই শাক খেয়ে থাকতেন। শুধু তাই নয়, তিনি অতিথিদেরও শাক দিয়ে আপ্যায়ণ করতেন। মানুষ তীর্থের পাশে ছিল সিদ্ধগণ ঘোষিত অংগা নদী। সেখানে দেব ও পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে শ্যামাশাক রান্না করে খেতে দিতে হত।
সে আমলের ঋষি, মহর্ষিরা বিভিন্ন রকমের অখাদ্য কুখাদ্যও খেতেন। অবশ্যই শখ করে খেতেন না। কোন কিছু না পেয়ে যা পেতেন তাই খেতেন। কোন বাছবিচার ছিলনা। উপাধ্যায় আয়ুধধৌম্যের শিষ্য উপমন্যু এক সময়ে বাছুরের মুখ নিঃসৃত ফেনা খেয়ে কাটিয়েছেন। পরীক্ষিৎ আরেক তপস্বীকে দেখেছিলেন যিনি বাছুরের মুখ নিঃসৃত ফেনা খেয়ে জীবনযাপন করছিলেন। ওই গুরুর আরেক শিষ্যের নাম উতঙ্ক। তিনি আবার এক সময়ে গুরু পত্নীর দুটো কানের দুল আনার জন্যে পৌষ্যপত্নীর কাছে গিয়েছিলেন। গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্যে ওই দুটো কানের দুলই তাঁর দরকার ছিল। রাস্তায় কিছু খাবারদাবার না পেয়ে ঋষি উতঙ্ককে ষাঁড়ের গোবর ও মূত্র খেতে হয়েছিল। কাম্পিল্যনগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর পুত্র পূজনী নামের এক পাখির নেইয়ে আসা ফল খেয়ে বড় হয়েছিলেন। পূজনী পাখি রোজ দূরের সমুদ্রতীরস্থ বন থেকে রোজ দুটো করে ফল নিয়ে আসত। একটা খেতেন ব্রহ্মদত্তের ছেলে। অন্যটা খেত পূজনী পাখির ছানা। অগস্ত্য মুনি একবার এক সমুদ্র জল উদরস্থ করেছিলেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়।
আজব খাওয়া খেতেন বালখিল্য ঋষিরা। এঁদের বুড়ো আংলা বললেও ভুল হবেনা। তাঁদের উচ্চতা ছিল বুড়ো আঙুলের মতো। এই ঋষিরা চামচিকের মতো উলটো হয়ে গাছের ডালে ঝুলে থাকতেন। এই ঋষিরা সূর্যের আলো খেতেন। অর্থাৎ তাঁদের কিছুই খেতে হত না। গাছের পাতা যেমন সূর্যের আলো থেকে শক্তি টেনে যেভাবে নিজেদের খাবার নিজেরাই রান্না করে, ত্মনি হয়তো বালখিল্য ঋষিরা নিজেদের খাবার নিজেরাই শরীরের মধ্যেই তৈরি করে নিতে পারতেন। যার ফলে শুধুমাত্র সূর্যের তাপ লাগলেই তাঁদের ভোজন সম্পন্ন হত।
বালখিল্য ঋষিরা ছাড়াও অনেকে হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকতেন। একবার মহর্ষি বেদব্যাস সৎ পুত্র লাভের জন্যে ভগবান শিবের তপস্যা করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি শুধু মাত্র হাওয়া খেয়ে জীবনধারণ করতেন। অন্ররজুনও একবার যুদ্ধাস্ত্র পাওয়ার জন্যে ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তখন তিনি প্রথম মাসে তিন দিন পর পর খেতেন। দ্বিতীয় মাসে ছদিন পর পর। তৃতীয় মাসে পনের দিন পর পর খেতেন। চতুর্থ মাস থেকে তিনি স্রেফ হাওয়া খেয়েই তপস্যা করতেন। রাজা যযাতি অম্বু ভক্ষণে তিন বছর ও বাউয় ভক্ষণে এক বছর কাটিয়েছিলেন। প্রভাসতীর্থে যুধিষ্ঠির তপস্যা করার সময়ে বারোদিন হাওয়া খেয়ে কাটিয়েছিলেন। যম গোমর্ণতীর্থে তপস্যা করার সময়ে ফলমূল, পাতা ও হাওয়া খেয়েছিলেন। যযাতি স্বর্গে যাওয়ার আগে ছ'মাস হাওয়া খেয়েছিলেন। হাওয়া খেতে খেতেই তিনি স্বর্গারোহণ করেছিলেন।