রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি চেপে হাওড়া
যাওয়ার সখ ছিল আমাদের তিনজনের। ড্রাইভার যেতে রাজি হলেন। কিন্তু অকপটে জানালেন
মিটার ভাড়ার চেয়ে কুড়ি টাকা বেশি লাগবে। পরিবর্তন হয়েছে। ড্রাইভারের কথা এবং দাবি
শুনে বুঝতে পারলাম। কোলকাতায় আসার সুযোগ আমার খুব একটা হয় না। কালে ভদ্রে আসি। দিন
দুয়েক থাকি। আবার ফিরে যাই। যখন আসি তখন বাসের ভিড় এড়াতে ভাড়ার ট্যাক্সির শরণাপণ্ণ
হই। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি কোন ট্যাক্সি ড্রাইভারের মুখে এইরকম অন্যায্য দাবি
শুনিনি। মিটারের ওপর কেন কুড়ি টাকা লাগবে! পরিবহণ মন্ত্রীর নিজের গাড়ি আছে। তাঁকে
ট্যাক্সি চেপে কোলকাতা ঘুরতে হয় না। তাই তিনি জানেন না মনে হয়। তাঁর কানে আমার
কথাটা যদি কেউ পৌঁছে দিতেন তবে প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে কুড়ি টাকা ডাকাতি করা হচ্ছে
কেন তার জবাব নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
রাতে কোলকাতায় পিজির পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল। উদ্দেশ্য ছিল
সাঁতরাগাছি যাব। এক ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরও বাসে ওঠার সুবিধা করতে পারলাম না। বাদুড়ঝোলা
ভিড়। রাত ন’টায় এইরকম ভিড় দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। রাত ন’টায় আমি এর আগে এত ভিড় এই
রুটে দেখিনি। ফ্লাইওভারের নিচে বাসের অপেক্ষায় যাত্রী ভিড় বাড়ছে। লোকে অধৈর্য্য
হয়ে উঠছে। শুনলাম নাকি বাসের সংখ্যা কমেনি। কিন্তু এত গরম পড়েছে যে লোকে দিনের বেলায়
কম বেরোচ্ছে। যাক, তাও ভাল। কারণ সরকারি বাসের সংখ্যা কমছে জানি। কিন্তু বেসরকারি
বাসের সংখ্যা কমেনি শুনে আনন্দিত হলাম। আমার দুই হাতে দুটি ব্যাগ। ট্যাক্সি নেই।
শাটল ক্যাবও নেই। বাস নেই। ধন্য কোলকাতার মানুষ। এই রকম বাদুড়ঝোলা ভিড়ে বাসের
দরজায় ঝুলে আছে গোটা পনের পুরুষ ও মহিলা। কিন্তু কোলকাতা তিলোত্তমা। এই অসহনীয় ভিড়েও
কোন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখলাম না।
আমার মতোই আরেকটি গোবেচারা পিঠে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে রাস্তার ধারে রেলিং
ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথার ওপর ফ্লাইওভার। ফ্লাইওভারের নিচে বড় বড় থাম। তার চারদিকে
এই রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর এক বছরের স্থায়িত্বের জন্যে সরকারের তরফ থেকে মা
মাটি ও মানুষকে অভিনন্দন। ফটোতে মুখ্যমন্ত্রীর হাসি হাসি মুখ। বড় বিরক্তিকর। মানুষ
ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত। বাস না পেয়ে
দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। তার মধ্যেই প্রতিটি থামে মুখ্যমন্ত্রী চেয়ে চেয়ে দেখছেন আর হাসছেন।
ঝাঁ চকচকে আলোর রোশনাই। একবছরের এই সরকার যে কত খুশি আছে তা থামের পোস্টার,
গ্লোসাইন বোর্ডের নীল সাদার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর দুষ্টু হাসি দেখলেই বোঝা যায়।
কোলকাতা এখন তো এই খুশির আলোয় ঢেকে গেছে। এর আগে অন্য কোন রাজ্যে এক বছর বয়স্ক
সরকারকে এত খুশি আমি দেখিনি। রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গোবেচারা ছেলেটা না থাকতে
পেরে মন্তব্য করল, আমরা কাঁদছি আর তাই দেখে মুখ্যমন্ত্রী হাসছেন।
এক ঘন্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমার দাদা ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে, কোথায়
রে তুই? আমি আর কোথায়। যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি। এক পাও এগোতে পারিনি। এর
মধ্যেই লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দুষ্টু হাসির গ্লোসাইন বোর্ডের আলো
নিভে গেছে। ভালই হল। আমাদের মতো দীন দরিদ্র অতি সাধারণ যাত্রীর দুর্দশা দেখে
মুখ্যমন্ত্রীর দুষ্টু-মিষ্টি হাসি আর দেখতে হচ্ছেনা। অন্ধকারই ভাল। কাটা ঘায়ে
নুনের ছিটের মতো গ্লোসাইন বোর্ডগুলি থেকে ঠিকরে বেরোন হাসিগুলি এইরকম বিপর্যস্ত
পরিস্থিতে বড়ই বেমানান। দাদা মোটর সাইকেল নিয়ে অবশেষে যখন পিজি স্টপেজে এল তখন রাত
সাড়ে ন’টা। যাক, এই যাত্রা বাসে চাপার দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেলাম।