বারবার যদি একটা মিথ্যে কথা বলা হতে থাকে তাহলে বেশ কয়েকবার বলার পর তা সত্যি মনে হতে থাকে। আজ ভোররাতের দিকে হাতিবাগানের বাজার পোড়ার পেছনেও তিনি হয়তো বিরোধীদের অন্তর্ঘাত দেখতে পেলেন। মডেল পুনম পান্ডের ছবি এবং আরও কিছু ছবি মিশ্রিত করে একটি বিতর্কিত ও বিকৃত ছবি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গের একটি সংবাদপত্রে ছেপে যাওয়ার পর খানিকটা গোলযোগ হয়েছিল। সেখানেও তিনি অন্তর্ঘাত দেখতে পেলেন। বিরোধীদের ‘দেউলিয়াপনা’র নিদর্শন বলে তিনি এই মামলাকে চিহ্নিত করলেন। তিনি তদন্ত না হওয়ার আগেই বললেন, তদন্ত হলেই সব ধরা পড়ে যাবে!
যখন তিনি সরকারে আসেননি তখন বারবার মাওবাদীদের সঙ্গে মিলেমিশে অন্তর্ঘাত করতেন। এবং তাঁর মাওভাইদের সুরক্ষা প্রদান করতেন। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, জনসাধারণের কমিটি এবং আরও নানাধরণের কমিটিতে গিয়ে তিনি মিটিং মিছিল করতেন। যে সব জায়গায় পুলিশ সাবধানে চলাফেরা করত সেইসব জায়গায় তিনি বেমালুম সাইকেলের পেছনে চেপে পৌঁছে যেতেন। বলতেন ‘মাও ফাও কিছু নেই’।
যেখানে যেকোন রকমের গন্ডগোলই হোক না কেন, তিনি সবকিছুর পেছনে অন্তর্ঘাত দেখতে পাচ্ছেন। বিরোধীপক্ষ অন্তর্ঘাত করছে এই বিষয়ে তিনি মন্তব্য করে বলে দিচ্ছেন তদন্ত হবে। তদন্ত না করে রাজ্যের শীর্ষস্থানে বসে নিজের মত জাহির করে তদন্তকারীদের অনুসন্ধানকে তিনি ‘সহজতর’ করে দিতে চাইছেন। তিনি একবার বিধানসভায় বলেছেন, এরপর যা ঘটবে তার সব দোষ তিনি বিরোধীপক্ষের ওপর চাপাবেন। হচ্ছেও তাই। কিছু একটা ঘটলেই তিনি ঘটনাকে ‘সাজানো’ বলে দিচ্ছেন। অবশ্য মানুষ এর ফলে তাঁকে ‘সাজানো ব্যানার্জি’ নাম দিয়ে ফেলেছেন। তবে তাঁর ভবিষ্যৎবাণী কখনোই ঠিকঠাক মিলছেনা। সব সাজানো ঘটনার পেছনে তাঁর দলের লোকদের হাত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সেইসব চাপা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি অবিরাম মিথ্যা কথা বলে চলেছেন।
পুলিশের পোয়াবারো। তদন্ত না করলেও চলে। ম্যাডাম নিজে মন্তব্য করে বাতলে দিচ্ছেন তদন্তের রাস্তা। ম্যাডামকে খুশি করতে তাঁর সন্দেহকে সত্যে রূপায়িত করতে পারলে পুরস্কারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। নইলে কপালে তিরস্কার। নইলে দময়ন্তী সেন। সুতরাং যেকোন নতুন পুরোন ঘটনাতে বিরোধীপক্ষের বিভিন্ন ধরণের নেতা ও কর্মীদের নাম ঢুকিয়ে তদন্ত করার অজুহাতে একেকজনকে জেলে পুরে চারদিকে ‘রাষ্ট্র’ করে দিতে হবে অমুক নেতা জেলে গেলেন। তবে বিরোধীপক্ষের সম্বন্ধে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে। বারবার জেলে যাচ্ছে কেন এরা? নিশ্চয়ই কোন ব্যাপার আছে। নইলে এতদিন জেলে থাকবে কেন?
নৈরাজ্য এলে এরকম হয় শুনেছি। আসল দোষীকে লুকিয়ে ফেলতে অনেক নির্দোষ লোকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হয়। গুন্ডারা কলার উঁচু করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর সাধারণ মানুষেরা তাদের ভয়ে কুঁজো হয়ে চলাফেরা করে।
বিকৃত যে ছবিটা দেখে বা না দেখে মমতা আবার আনতাবড়ি মন্তব্য করলেন, সেই ছবিটা অনেকদিন আগে থেকেই ফেসবুকে ঘুরছে। শুধু অতি উৎসাহী কোন লম্পট তার মধ্যে পুনম পান্ডের মুখ বসানো একটি নগ্নিকার ছবি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তদন্তের ভার পেয়েছে সিআইডি। ছবিটা দেখলেই বোঝা যায় কোন লম্পট অস্থিরতা তৈরি করতে এরকম ছবি সাইবার দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে সিআইডি তাদের তদন্ত কোনদিকে নিয়ে যায় দেখা যাক। এরকম একটি মামলাতে সিআইডিকে সাইবার বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দা বিভাগ এই মামলার সুরাহা করতে পারবেনা বলেই মনে হচ্ছে। হতে পারে ছবিটা ভারতের বাইরে বসে বানানো হয়েছে। তারপর ফেসবুকের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। এই ধরণের ছবি বিকৃত করে বানিয়ে প্রচারে বারবার আনা হচ্ছে। সম্প্রতি কাশ্মীরে মুসলমান সম্প্রদায় এইরকম একটি ছবির উগ্র বিরোধিতা করেছেন। মন্দিরে বা মসজিদে মাংসের টুকরো এখনও ইচ্ছে করে ফেলে রাখা হয়। কোথাও চটি বা জুতোর মধ্যে দেবী বা দেবতার ছবি ছেপে দেওয়া হয়। ধর্মীয় দাঙ্গার সূত্রপাত এই ধরণের অতি তুচ্ছ ঘটনা থেকেই শুরু হয়ে যায়। কোথাও হিন্দু বিদ্বেষ দেখানো হচ্ছে। কোথাও বা মুসলমান বিদ্বেষ দেখানো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তবে এই রাজ্যে উস্কানিমূলক এই ধরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্তির হার নগণ্য। সংবাদমাধ্যমে যদি ছবিটা না প্রকাশ পেত তবে সমস্যাই ছিলনা। ৩৪ বছরের বাম শাসনের প্রভাবে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ও বিদ্বেষ কম চোখে পড়ে।
মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য অনুযায়ী সিআইডি তদন্ত করে বিরোধীপক্ষের কাকে জেলে ঢোকায় দেখা যাক। ‘সাজানো ব্যানার্জি’র পাগলামি বন্ধ করার আবেদন করা যাক এবার। তদন্ত হোক মস্তিষ্কের কোষগুলির। দেখা যাক কি বেরোয়!