Subrata Bakshi |
বিশ্বায়নের যুগে সবকিছুই পণ্য। তাই সবকিছুই বিক্রি হয়। যেমন শিক্ষা বিক্রি হয়। শিক্ষক বিক্রি হয়। তেমনি চিকিৎসা আর চিকিৎসকও বিক্রি হয়। যেমন খেলা বিক্রি হয়। আবার খেলোয়াড়ও বিক্রি হয়। বিনোদন বিক্রি হয়। তার সঙ্গে বিনোদিনীকেও পয়সা দিয়ে কেনা যায়। মেয়ে বিক্রি হয়। আবার জামাইও বিক্রি হয়। রাজনীতি বিকৃত। চোখ রাখলে দেখা যায় বিক্রিও হচ্ছে। রাজনেতা বিক্রি হয়। সংসদ বিক্রি হয়। সাংসদ বিক্রি হয়। কিনা বিক্রি হয় আমাদের দেশে! কয়লা খনি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তেলের খনি বিক্রি হয়ে গেছে। পেনশন ফান্ডকে বলা হয় টাকার খনি। তাও বিক্রি করে দিল এরা। দেশটারও অর্ধেক বিক্রি হয়ে গেছে। গণতন্ত্রের যে কটা স্তম্ভ আছে তার পাশে দাঁড়ালে বোঝা যায় সবকটা থামে ঘুণপোকা ধরেছে তবুও লোভনীয় দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থ স্তম্ভের নাম সংবাদ মাধ্যম। যদিও এটা সংবাদ কোম্পানিগুলোর স্বঘোষিত নাম। ওটাও অনেকে মিলে কিনে নিয়েছে। খবর কোম্পানি খবর “ম্যানুফাকচার” করে চলেছে। বিক্রি করতেই হবে। তাই এমন খবর বানাতে হবে যেন বিক্রি হয়ে যায়। নামকরা সিনেমা তারকার একটি সন্তান প্রস্রব হলে প্রথম পাতার হেডলাইন। কিন্তু ততক্ষণে দেশের বহু নবজাত জন্মেই মরে গেল। অনেকে না খেতে পেয়ে মরে গেল। অনেকে বিনা চিকিৎসায় মরে গেল। তা যাক গে। পাবলিক ওসব শুনতে পছন্দ করছেনা আজকাল। তাছাড়া পাবলিকের মাথায় এইসব চিন্তা ঢুকিয়ে দিলে পাবলিকের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয়ে যাবে। জনতা তুমিই জনার্দন। সুখে থাক।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা আরও শোচনীয়। এখানে ছিল বাম আমল। বেশির ভাগ কাগজ কোম্পানিগুলো মিলেমিশে তাদের নিন্দা মন্দ করে এসেছে চিরকাল। এবার এসেছেন মমতা। মমতা একটু কাগজঘেঁষা মহিলা। কাগজের ক্যামেরা তাক করে আছে দেখতে পেলেই হন্তদন্ত হয়ে এমন করে দৌড়ে বেড়ান মনে হয় যেন বিয়েবাড়ির তিনি বরকর্তা। এদিকে বর এসে গেছে কিন্তু বরণডালাই কেনা বাকি রয়ে গেছে। ক্যামেরার সামনে এলেই হাত পা ছুঁড়ে সবকিছু সটাসট আর ফটাফট সারতে ইচ্ছে হয়। আগে কাগজ কোম্পানিগুলো বামেদের যতই একহাত নিক না কেন, ওরা কিন্তু মহাকরণ থেকে সাংবাদিকদের তাড়িয়ে দেয়নি। এখন ‘নিজভূমে’ পরবাসীর মতো অবস্থা সাংবাদিকদের। যেসব জায়গায় তারা অনায়াসের বিচরণ করত এখন গন্ধ শুঁকে শুঁকে পা ফেলতে হচ্ছে। আগে সব মন্ত্রীদের ‘দাদা’ বললেও কেউ গায়ে মাখতনা। এখন সবাই ‘স্যার’। মন্ত্রী সুব্রত বক্সীর খাপ্পা হওয়ার পেছনে এইরকম একটা আত্মাভিমান কাজ করেছে মনে হয়। বক্সী মশাই আবার খাপ্পা হলে বেখাপ্পা মন্তব্য করেন। তাই ‘প্রেস কর্নারে তালা’ ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো একটা দাম্ভিক মন্তব্য করতে তাঁর একটুও লজ্জা হলনা।
বিশ্বায়নের যুগে সবই তো পণ্য। বক্সী মশাই যা বলবেন তাই তো খবর। তাই কাল সকালে বিক্রি হবে। মানেই পণ্য। মানে গরজটা সাংবাদিকদের। পেছন পেছন ঘুরঘুর কর। পঁচিশবার ‘স্যার’ বল। দরজা দিয়ে উঁকি মারছিস কেন রে শালা? মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব। দোষ বক্সী মশাইয়ের নয়। তাঁদের সরকার প্রচুর টাকা পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংবাদপত্রগুলোর মুখেই তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। তাই বেশির ভাগ সংবাদপত্র এইসব নিয়ে প্রতিবাদ করবেনা। এতকাল যাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত কাগজগুলো তারা এখন নিন্দা করে কি করে! লাজ রাখি নাকি কূল রাখি? কিছুই তো নেই। রাখবে কি আবার? যেসব সংবাদপত্রগুলো এখন ‘জরুরি অবস্থা’র গন্ধ শুঁকছে তাদের কলম কিন্তু ভোঁতা হয়ে গেছে আগেই। এত প্রশংসা লিখতে হয়েছে ফাঁকা মাঠে যে কলমের ধার বলে কিছু নেই। কলমও বিক্রি হয়ে গেছে। কলমের দামও কমে গেছে। তাই বুঝেই বক্সীমশাই বলতে সাহস করেছেন তালা ঝোলানোর কথা। সংবাদ বিক্রি হয়। সংবাদপত্রও বিক্রি হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা যেন বিক্রি না হয়ে যায় তালেগোলে!