ডাক্তারিতে যার তার পাশে ‘টিস’ লাগিয়ে দিলে একটা রোগ বাধিয়ে দেওয়া যায়। হেপাটাইটিস, কঞ্জাক্টিভাইটিস, সাইনোসাইটিস, অস্টিওমায়েলাইটিস, সিস্টাইটিস এবং অসংখ্য। সেলফি সংক্রান্ত রোগের নাম রাখা যাক সেলফাইটিস। এই রোগের কারণ, তার সংক্রমণ, তার প্রভাব ও প্রতিকার ইত্যাদি নিয়ে গবেষণার নাম রাখা যাক সেলফোলজি। সেলফোলজি নিয়ে পড়াশোনা করার জন্যে আপনাকে ফেসবুকের ভেতর ঢুকে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে। ইনস্টাগ্রাম আর টুইটারে হাবুডুবু খেতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে স্ট্যাটাস আপডেট দেখতে হবে। ঘনঘন মোবাইল খুলে এইসব সোশ্যাল সাইটগুলো স্ক্রল করতে হবে। দেখবেন রং। দেখবেন রঙ্গ।
সেলফাইটিস রোগে আমি কম ভুগিনি। গোরুর সঙ্গে সেলফি যখন লঞ্চ হল তখন আমি তার প্রতিবাদে আমার ফার্মের একটা রামপাঁঠার সাথে সেলফি পোস্ট করেছিলাম। হুহু করে লাইক পড়ছিল। সেদিন পাঁঠার প্রশংসায় পঞ্চমুখ আমার ফেসবুক পাড়া। কি সুন্দর রং। ড্যাম স্মার্ট! ইত্যাদি, ইত্যাদি। লজ্জা পেলাম একজনের কমেন্ট পড়ে। তিনি লিখলেন, ব্র্যাভো ব্রাদার্স। এই কমেন্টটা আমার ভাল লাগেনি। আমি আর পাঁঠা কিনা দুই ভাই! এই ব্যাপারটা ঠিক হজম হলনা। তালেগোলে ভাবতে শুরু করলাম লোকগুলো আমার পাঁঠাকে দেখে কমেন্ট করছে নাকি আমার উদ্দেশ্যে বলছে! আমাকেও কি ওরা পাঁঠা ভাবছে! আমাকে কি ওরা পাঁঠারও অধম ভাবছেনা! ছবিতে কি আমার চেয়ে পাঁঠাটাকে বেশি স্মার্ট লাগছে! আমি দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পাঁঠাটা কেমন গম্ভীর, ধীরস্থির। আমাকেই কি পাঁঠার মতো লাগছে! চিন্তাগুলো সেই যে জট পাকাল আর খুলতে পারলাম না। আমি আমার সেই সেলফি পোস্ট ডিলিট করে দু’ফুঁক বিড়ি টেনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কোনদিন বাজারে সেলফি ছাড়বনা। তারপরে ছাড়িওনি। সেলফাইটিস রোগ আমার সেদিন থেকে সেরে গেছে। কিন্তু এখন হয়েছে আমার সেলফোবিয়া।
সেলফোবিয়া রোগটা সেলফাইটিসের রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যেমন জ্বর সেরে গেলেও কয়েকদিন ঘোর থেকে যায়। সব সময়ে ঘুম ঘুম পায়। সেইরকম সেলফাইটিস সারল কিন্তু কারও সেলফি দেখলেই আতঙ্ক শুরু হল। সবার মুখের সেলফির মধ্যেই আমার রামপাঁঠাকে গম্ভীর মুখে তাকাতে দেখছি আর আমি যেন ঠিক তার পাশে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে সেলফি পোস্ট করছে তাকে আর দেখছি কই! সেই ডিলিট মারা সেলফিকে ভুত দেখার মতো ঘুরেফিরে দেখছি। সেলফাইটিসের এত মারাত্মক সাইড এফেক্ট দেখে আমি খুব চিন্তায় আছি। তাই প্রতিকার খঁজতে সেলফোলজি নিয়ে পড়ছি।
তাতেও বিপদ কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। সেলফোলজির ঘোরে অন্যের পোস্ট করা সেলফি খুঁজতে খুঁজতে আমি ফেসবুক সমেত একবার পাকা রাস্তার ধারে বড় ড্রেনে পড়েছি। কয়েকবার গরম ভাতের থালার ওপর বসেছি। একবার কোন দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট তুলে নিয়েছি। অপদস্থ হয়েছি খুব। কত কি যে হয়েছে তা নিয়ে একটা গল্প লেখা যায়।তাও সোশ্যাল সাইটে সেলফি দেখা ছাড়িনি।
আজ আমাদের তিনটে বাড়ি পরের এক প্রতিবেশী হারাধনের সেলফি দেখছি। গতকাল ট্রেনে চাপিয়ে দেওয়ার আগে হারাধন একটা সেলফি পোস্ট করেছে। আমি, মদন আর হারাধন। সঙ্গে ট্রেনের ব্যাকগ্রাউন্ড। ও ট্রেনে চেপেছে। আমি আর মদন বাড়ি চলে এসেছি। মদন আমার ভাই। এক ঘরে পাশাপাশি খাটে শুই। এক ছাদের নিচেই রাত কাটাই। মদনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক সময়ে বিচ্ছিন্ন থাকছে। কিন্তু হারাধনের সঙ্গে সব সময়ে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। ট্রেনে বসে হারাধন বাদাম খেতে খেতে সেলফি দিল। আমি বললাম, মিসিং ইউ। তারপর ট্রেনের বার্থে চাদর বিছানোর সেলফি। ট্রেনের বাথরুমের আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে নতুন ধরণের সেলফি। রেল ক্যাটারিং-এর রাতের খাবারে লিকলিকে মুরগির ঠ্যাং আর পোলাওয়ের সেলফি। ট্রেন থেকে নেমে সেলফি। ট্যাক্সি চেপে সেলফি। হোটেলে ঢুকে সেলফি। গামছা পরে, উবুড় হয়ে শুয়ে, চা খেতে খেতে, বাগানে গিয়ে ফুল গাছে গা এলিয়ে, লাউঞ্জে ঠ্যাং ছড়িয়ে সেলফি। রেস্তোরাঁয়ে ঘিয়ে রং-এর টেবিলের ওপর এক গ্লাস জল, সাদা ধবধবে চীনেমাটির ডিশ আর কয়েকটা কাঁটা চামচের সঙ্গে সেলফি। পার্কে গিয়ে আলতো করে গাছের ডাল ধরে সেলফি। হারাধনের সেলফিগুলোর সবকটাতেই ‘মিসিং ইউ’ লিখতে হচ্ছে। না লিখলে সম্পর্ক থাকেনা। হারাধন ভুলে গেলে বিপদ। বাছাধন গেছে ভেলোরে ডাক্তার দেখাতে। আমি তাই বাবার জন্যে একটা ওষুধ আনতে বলেছি। ওখানেই পাওয়া যায়। মনে থাকলে নিয়ে আসবে বলেছে। যদি কমেন্ট না করি তাহলে ভুলে যেতে পারে। আমি লাইক আর কমেন্ট মেরে যাচ্ছি।
এই করতে আমি ঘোরের মধ্যে চেয়ারে বসে টিভি দেখতে দেখতে ঘোরের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমিয়েও আমার কোন কিন্তু শান্তি নেই। স্বপ্নে হাজার হাজার রামপাঁঠাকে দিনে পঁচিশবার করে সেলফি পোস্ট করতে দেখছি।