প্রায় বছর পনের আগে একটা হিন্দি সিনেমার কথা মনে পড়ছে। সেই সিনেমার নায়ক তার ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন পোশাক পরিহিত ছবি টাঙিয়ে রাখত। সেই সিনেমার নায়িকার সামনে সে একটা ভেক ধরে ঘুরত। নায়িকা ভাবত তার সাধের প্রেমিক বুঝি কোন দাপুটে কেউকেটা। তবে নায়ক একদিন ধরা পড়ে গেল নায়িকার হাতে যেদিন নায়িকা সেই সিনেমার নায়কের শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে উকিল্, ডাক্তার, পুলিশ, প্রফেসার বা নেতাদের মতো পোশাক পরে সেজেগুজে ছবি দেখতে পেল। সেই আমলে গ্রামের মেলায় গেলে স্টুডিওতে বিশাল কোন নায়কের ঘাড়ে হাত দিয়ে ফটো তোলা যেত। বিভিন্ন পোশাক পরেও ফটো তোলানো যেত। এখন আর এসব করতে হয়না। এখন ফোটোশপের মাধ্যমে যা খুশি করা যায়। ছেলে ছোকরারা এসব করেও। অনেক অনেক মজার মজার ছবি তৈরি করে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও তাই করছেন।
বর্তমান সরকারও আজকাল তাই করছে। সদ্য চরকায় বসে সুতো কেটে গান্ধিজি সেজে ফটো তুলে খাদির ক্যালেন্ডার ছাপিয়ে দিয়েছে। সেই সিনেমাটার নাম আমি ভুলে গেছি। কিন্তু থিমটা একই লাগছে। সরকারের সাইবার সেলও তাই করছে। যা হয়নি তাই দেখাচ্ছে। নায়কের মহিমা চওড়া করতে এসব আজকাল খুব দরকার পড়ছে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। মানুষ সিনেমার মতো নায়ক হতে চায় যে কিনা এক ফুঁ’য়ে পৃথিবী উলটে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।
চেন্নাইয়ে গত বছর ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি সেখানে পৌঁছেছিলেন পরিস্থিতির মূল্যাঙ্কন করতে। সবাই করেন। বিমানের ভেতর বসে আকাশে ভাসতে ভাসতে তিনি নিচের দিকে তাকাচ্ছেন আর সুস্পষ্ট ডুবন্ত চেন্নাইয়ের ছবি তিনি দেখছেন। পরে প্রমাণ করা হয় যে প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো যে ছবিটা বাজারে ছেড়েছে তা আদৌ সত্যি নয়। এটা ছিল মেঘলা আকাশের অস্পষ্ট ছবি। সেটাকে ফটোশপে এডিট করে অন্যরকম বানানো হয়েছিল। চুরি ধরা পড়ে গেলে তড়িঘড়ি সরকারি সংবাদ মাধ্যম বা প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো সেই ছবি নিজেদের সাইট থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মোদি যে কতবড় প্রধানমন্ত্রী তা প্রমাণ করতে ভক্তরা একটি ফটো ফটোশপ করে। একটা যুবকের ঝাঁটা হাতে ঘর ঝাঁট দেওয়ার ফটোর মধ্যে মোদির মুখ বসিয়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী চাওয়ালা থাকাকালীন কিভাবে ঘর ঝাঁট দিতেন তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেখানোর চেষ্টা হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একেবারে যাকে ‘গ্রাসরুট’ থেকে ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন। এর নামই গণতন্ত্র। ভারতের গণতন্ত্র, যেখানে কিনা চাওয়ালাও প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতে পারেন। সাধারণ গরীবগুর্বোদের মন কাড়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
গুজরাট যে স্বর্গ তা প্রমাণ করার জন্যে সরকারি সাইবার সেলের চেষ্টার অন্ত নেই। প্রধানমন্ত্রী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি কতটা উন্নতি করেছিলেন তা প্রমাণ করতে ভক্তরা আহমেদাবাদ বাস স্ট্যান্ডের একটা ফটো থেকে কয়েকটা বাস তুলে চীনের একটি ব্যস্ততম বাস টার্মিনাসে কায়দা করে বসিয়ে গুজরাট মডেল বলে বেমালুম চালিয়ে দিল। গুয়াংঝাউ বাস টার্মিনাসের সেই ফটো এখনো ভক্তরা বীরের মতোই গুজরাট মডেলের প্রচারে কাজে লাগাচ্ছে। হাসির খোরাকও হচ্ছে, কারণ দিনরাত চীনকে গালাগালি দিলেও স্বর্গের কল্পনা করতে চীনকেই টানতে হয়েছে।
এবার আরেক ভক্তের কাহিনী শুনুন। ভক্তের নাম প্রীতি গান্ধী। তিনি ডাকাবুকো বিজেপি নেতাও বটে। সেবার তিনি উইকিলিকস-এর নামে একটি পোস্টার তৈরি করে ফেসবুকে ছেড়ে দেন। যাতে মোদিকে যে আমেরিকাও ভয় পেতে শুরু করেছে সেই কথা ‘লিক’ করা হয়েছিল। পরে উইকিলিকস যখন এই কান্ড জানতে পারে তখন তারা বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয় যে তারা এমন কোন তথ্য জনসমক্ষে আনেনি। এটা ভুল তথ্য যা কিনা তাদের নাম দিয়ে চালানোর চেষ্টা হয়েছে।
এবার আরেক ভক্তের কান্ড শোনাই। ভক্তের নাম সি আর পাটিল। গুজরাটের সাংসদ। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদির একটি ছবি পোস্ট করেন যেখানে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেখা যাচ্ছে মন দিয়ে আমাদের দেশোয়ালি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনছেন। ভক্তরা এই ছবির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেউকেটাও মন দিয়ে দেশোয়ালি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনেন। তারমানেই আপনি বুঝে নিন এই প্রধানমন্ত্রী কতবড় প্রধানমন্ত্রী।
ট্যালগোর সঙ্গে সবে একটা চুক্তি হয়েছে। যার ফলে ভবিষ্যতে দ্রুতগামী ট্রেন আসতে পারে ভারতে। কিন্তু ভক্তদের আর সবুর সয়নি। আদ্দিকালের একটা প্ল্যাটফর্মে সেই বুলেট ট্রেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ভক্তরা। পাবলিক হাঁ হয়ে ভারতের আচ্ছে দিন দেখছে। যারা সেই ট্রেন দেখতে পায়নি তারা ফটোতে দেখেই বুঝে যাচ্ছে ভারতের আচ্ছে দিন এসে গেছে।
ভক্তরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ‘লৌহপুরুষ’ বলে। তিনি যে কত বড় পুরুষ তা দেখানোর জন্যে একটি মদ কোম্পানির ক্যালেন্ডারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে কায়দা করে দাঁড় করিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে তিনি সিংহের সঙ্গে প্যারেড করতেও একদম ভয় পাননা। মানুষ যেন বোঝে তাঁদের প্রধানমন্ত্রী কতটা সাহসী।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও তাঁর মার্কিন ভিসা পেতে বেগ পেতে হত। সেই আমলে ভক্তরা মোদির সঙ্গে ওবামার জাল ফটো প্রকাশ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে তৎকালীন ভারতের শাসক চাইতনা যে মোদি আমেরিকা যান। কিন্তু মোদি তো খোদ মার্কিন কর্তার সঙ্গেই ঘোরেন। তখন আবার ভিসা ফিসা কেন? মজার কথা হল, বরাক ওবামা তাঁর স্ত্রী মিশেল ওবামার সঙ্গে হাঁটছিলেন। মিশেল কে সরিয়ে তাঁর জায়গায় মোদিকে ঢুকিয়ে ভক্তরা মোদির কদর আর আদর দুটোই বাড়াতে চেষ্টা করেছিল।
উত্তরপ্রদেশের বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারের কভার ফটোটাই নকল ছিল। ফটোশপের কারিগরীতে একটাই ফটো বেশ কয়েকবার মিশিয়ে মিশিয়ে গেরুয়া ভীড় বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
ভক্তরা ফেসবুকে মোদিপ্রচারে অগুনতি পেজ খুলে রেখেছেন। তার মধ্যে সব সময়েই এইসব হাবিজাবি মিথ্যে ছবি পোস্ট হতে দেখতে পাবেন। কত রকম জালছবি যে মোদির প্রচারে কাজে লাগে তার হিসেব নেই। চাওয়ালা মোদি যে আজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাতে ভক্তদের খুশির অন্ত নেই। বাস্তব জগতের মোদির সঙ্গে সেই নায়ক মোদির অনেক তফাত। ভক্তদের দৌরাত্ম্যে মানুষ মোদি হারিয়ে গেছে। নায়ক মোদির পোস্টার ছাপানো হচ্ছে। মোদির চরকায় তেল দিচ্ছে ভক্তরা। মোদি গান্ধিজির চরকায় তেল দিচ্ছেন।