নন্দীগ্রাম থেকে হোঁচট খেতে খেতে পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ বামপন্থী দল যেন মধ্যমগ্রামে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এই জন্যেই দিকে দিকে খোলামেলা আওয়াজ উঠছে। তাই বুঝি লাশ নিয়ে রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাল ঠুকতে ঠুকতে সিটু সরাসরি মাঠে নেমে পড়েছে। এতদিন যে জঙ্গিপনা থেকে সিটু পিঠ বাঁচিয়ে চলত তারা এখন আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখেই লাফিয়ে উঠছে। নিতান্ত খাতা ভরানোর মতো যেসব আন্দোলন সিটু করত তা থেকে যেন সাত যোজন দূরে সরে এসে সিটু কর্মীর পারিবারিক সমস্যা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করছে। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেন যাঁরা তাঁদের কাছে এইসব সমস্যা ছিল নগণ্য। নীতি বদলানোর লড়াইয়ে কয়েকজন শ্রমিকের আত্মবলিদানকে যাঁরা বিশ্বায়নের ফসল হিসবে দেখতেন, নিদেনপক্ষে মালিকশ্রেণীর শোষণকে যারা ভারতের বিদেশনীতির প্রতিফলন হিসেবে দেখে আরও খানদুয়েক বিক্ষোভ মিছিল আর ধর্মঘট করে বসতেন, তাঁরা আজ মধ্যমগ্রামের এক অজানা কিশোরীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিভাবে নেমে পড়তে পারলেন!
কিশোরীর বাবা ট্যাক্সিচালক হিসেবে সিটুর সদস্য। মেয়েটি নির্যাতিতা। ধর্যিতা। এবং দুষ্কৃতীরা মেয়েটিকে আগুনে পুড়িয়ে মারল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বামপন্থীদের কাছে এইসব দুর্ঘটনা ছিল নস্যির সমান। আজ হঠাৎ কি সিটু পালটে গেল? উত্তর পাওয়া যাবে সম্প্রতি দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অস্বাভাবিক সাফল্যের মধ্যে। উত্তর লুকিয়ে আছে অরবিন্দের জন্যে মানুষের অপার আহ্লাদের মধ্যে। উত্তর লুকিয়ে আছে ‘আপ’এর ওপর মানুষের অগাধ ভরসার মধ্যে। অকংগ্রেস ও অবিজেপির ধুন তুলে বামপন্থীরা হালে পানি না পেলেও অরবিন্দের একই ধুনে মানুষ আত্মহারা। নীতির দোহাই দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং ‘কর্পোরেট কোরাপশান’এর বিরুদ্ধে যাঁরা কলম খোঁচাতেন, তাঁরা অরবিন্দের সাফল্যকে নিশ্চয়ই বিশ্লেষণ করতে বসেছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালই কৌশলে বামপন্থীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষের কাছে আসতে গেলে মানুষের সমস্যাকেই তুলে ধরতে হয়। জল ও বিদ্যুতের বর্ধিত মাশুল গোনা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকতে গেলে সেই সমস্যাকে আমেরিকার বিদেশনীতির সঙ্গে গুলে ঘোল বানিয়ে দিলে হয়তো চলবেনা। এইসব সমস্যাকে ভারতের বিলগ্নীকরণের নীতির সঙ্গে ঘেঁটে ঘ্যাঁট বানালেও চলবেনা। মূল্যবৃদ্ধির ফলে নাজেহাল মানুষের কাছে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে আমেরিকার আগ্রাসনের নীতির ব্যাখ্যা করে লাভ নেই। লাভ নেই দু’দশ হাজার লোক যোগাড় করে পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে ভারতব্যাপী জনসভার।
নন্দীগ্রাম থেকে মানুষ সাড়ে ছ’বছর দূরে চলে এসেছে। মানুষ এখন মধ্যমগ্রাম নিয়ে মাততে চাইছে। সিটু মানুষের নাড়ি টিপে বুঝেছে এখন তোমার নাম, আমার নাম, সবাইয়ের নাম মধ্যমগ্রাম হয়ে গেলে রাজ্যের শাসকদলের ওপর মোক্ষম চাপ পড়বে। সরকারকে চাপে ফেলতেই লাশের ওপর চেপে বসেছে সিটু। নইলে যুগ যুগ ধরে কত লাশই তো পড়ে পচে গেছে। কত মেয়েই তো ধর্ষিতা হয়ে জ্বলে পুড়ে মরেছে। কত মানুষই তো ব্যাপক শোষণ মুখ বুজে সহ্য করেছে। তাই এতদিন যাকে শুধুই পারিবারিক সমস্যা আখ্যা দিয়ে সিটু হাত পা ধুয়ে বসে যেত, সেই সমস্যা নিয়ে লাফ দিয়ে মাঠে নেমে পড়তে দেখে সিঁদুরে মেঘের মধ্যে আগুনের আঁচ পাওয়া যায় বইকি।