কিষেণজি খুনের এক সপ্তাহ পরে ডিসেম্বরের ৪ তারিখের মাঝরাত থেকে ৫ তারিখের মাঝরাত পর্যন্ত দুদিনব্যাপী ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছিল মাওবাদীরা। বড় এক নেতার মৃত্যুর অনেকদিন পর ভারত বন্ধের ডাক শুনে তাদের শক্তি নিয়ে একটু সন্দেহ জাগে বইকি। ছোটখাটো নেতার মৃত্যু পর এরা দুদিনের মধ্যেই ভারত বন্ধ করে দিতে পারে। কোন নেতা বা কর্মী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেলে এরা একদিনের মধ্যেই ভারত বন্ধ করে দিতে পারে।
কিন্তু একজন শীর্ষনেতার মৃত্যুর পর ভারত বন্ধ করতে এতদিন সময় লাগল কেন! ঝাড়খন্ডের বাসিন্দারা জানেন, বিশেষ করে যারা পালামৌ অঞ্চলের বাসিন্দা তারা জানেন যে অনেক সময়ে ভোরবেলা বাস ধরতে এসে বাসস্ট্যান্ডে খবর পাওয়া যায় যে সেদিন ভারত বন্ধ থাকবে। এ অঞ্চলের মানুষ বন্ধ হলেই ধরে নেন সেদিন ভারত বন্ধ। কারণ পালামৌ আর লাতেহার জেলার লোক নিজেদের জেলাকে সম্পূর্ণ বন্ধ দেখে চিন্তা করতেই পারেন যে সমগ্র ভূভারতে এই অবস্থাই করে রেখেছে মাওবাদীরা।
দুদিনব্যাপী ভারত বন্ধে ঝাড়খন্ডের একটি চালচিত্র তুলে ধরা যাক। মাওবাদী নাশকতার স্বীকার হয়েছে দুটি থানা। ছতরপুর আর হরিহরগঞ্জ থানা। একই অঞ্চলের এই দুটি থানা ছাড়া ঝাড়খন্ডের আর কোন থানায় এরা আক্রমণ করেনি। কিংবা আক্রমণ করে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিহারের ঔরঙ্গাবাদ জেলার টন্ডবা থানাও আক্রান্ত হয়েছে। ঔরঙ্গাবাদ জেলা পালামৌ অঞ্চলের লাগোয়া জেলা। ছতরপুরের পাশেই হায়দারনগর। সেখানে একটি মোবাইল টাওয়ার উড়িয়ে দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। হাজারিবাগ জেলার বিষ্ণুগড় অঞ্চলে লরি পুড়িয়ে দিয়েছে। পাকুড় জেলায় খনিজ বহন করার কয়েকটি ‘ডাম্পার’ পুড়িয়ে দিয়েছে। হরিহরগঞ্জের ব্লক অফিস উড়িয়ে দিয়েছে। ছতরপুরের একটি স্কুলে বোম মেরে একটি ঘরের ক্ষতি করেছে। এছাড়া বিহারের পুর্ব চম্পারণ জেলার একটি মোবাইল টাওয়ার পুড়িয়ে দিয়েছে। গয়া জেলায় দুটি অটোরিক্সা পুড়িয়ে দিয়েছে। এই হল দুদিনব্যাপী ভারত বন্ধে ঝাড়খন্ডের নাশকতার তালিকা। কোথাও কোন লোকের মৃত্যুর খবর নেই।
সবচেয়ে ভয়াবহ কান্ড ঘটে গেছে পালামৌ অঞ্চলের লাতেহার জেলা্র বেতলা ব্যাঘ্র প্রকল্পের ঘন জঙ্গলের মধ্যে। তবে এটি মাওবাদীদের ডাকা ভারত বন্ধের সাত ঘন্টা আগের ঘটনা। বর্তমান নির্দল সাংসদ ও প্রাক্তন স্পিকার ইন্দর সিং নামধারীর বুলেটপ্রুফ গাড়িটা সামনে ছিল। যে পুলিশ ভর্তি গাড়িটা সামনে থাকার কথা, তা ছিল পেছনে। নামধারীর গাড়ি পাওয়ারঘাটের ছোট্ট পাহাড়ি ‘পুল’ পেরিয়ে যাওয়ার পর পুলিশের জিপটা ওই পুলের ওপর এসে পৌঁছোতেই ল্যান্ডমাইন ফাটিয়ে দেওয়া হয়। মাওবাদীরা একদম কাছ থেকে রিমোটের মাধ্যমেই এই কাজ করেছে বলে বলা হচ্ছে। পুলিশ ভর্তি গাড়িটা হাওয়ায় উড়ে পঞ্চাশ ফুট দূরে গিয়ে পড়ে। এবং ঐ গাড়ি লক্ষ্য করে তখন চারিদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসে । তৎক্ষণাত দশজন পুলিশের মৃত্যু ঘটে যায়।
ঝাড়খন্ডে মাওবাদীদের বাড়বাড়ন্ত রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের মদতেই। যে কোন রাজনৈতিক দল এদের ব্যবহার করে ভোট বৈতরণী পার হয়ে যায় নির্বিঘ্নে। নামধারী ও তাঁর পরিবারের অনেকের ঝাড়খন্ডের মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলেই ব্যাবসার গন্ডি। পালামৌ, লাতেহার ও গঢ়বা জেলায় নামধারী পরিবারের বিভিন্ন ধরণের ব্যাবসা আছে। শোনা যায় মাওবাদীদের হাতে তোলা না তুলে দিলে এত ব্যাপকভাবে এই অঞ্চলে ব্যাবসা করা সম্ভব নয়। পালামৌর ডালটনগঞ্জ শহরেই নামধারীর আদিবাড়ি। এই শহর মাওবাদীদের কার্যকলাপের জন্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এদের ডাকা ভারত বন্ধ হলে ডালটনগঞ্জ শহর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই শহরেই মাওবাদীরা দিনে দুপুরে বাজারহাট করতে আসে। তাই মাওবাদীদের সঙ্গে ইন্দর সিং নামধারীর সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও একই অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে একটি আত্মিক সম্পর্ক অস্বীকার করা যায়না। নয়তো এই অঞ্চল থেকে ব্যাবসার পাট গুটিয়ে অনেকদিন আগেই এই পরিবারকে ভিটে হারাতে হত। অকূত সম্পত্তির মালিক নামধারী পরিবারের সদস্যদের এই অঞ্চল জুড়ে অবাধ বিচরণও সম্ভব হতনা।
ভারত বন্ধের দুদিন পশ্চিমবঙ্গে কোন নাশকতা সম্ভব হয়নি। তার কারণ আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি রাজনৈতিক দল খোলাখুলি এদের সাহায্য করত। এখন একটু দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তাই জঙ্গল অঞ্চলের গ্রামগুলিতে মাওবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করার হিড়িক কমে গেছে। আজ যেসব কমিটি ও সমিতিকে নিষিদ্ধ করার কথা ভাবা হচ্ছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী তাদের সঙ্গে একই মঞ্চে সভা করেছেন। অন্যদিকে ঝাড়খন্ডে দলমত নির্বিশেষে মাওবাদীদের রাজনৈতিক সাহায্যে একচুলও ঘাটতি হয়নি। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত সামন্তদের নিজেদের জীবন বাঁচাতে মাওবাদীদের সঙ্গে আপস করেই থাকতে হচ্ছে। সাধারণ গ্রামীণ আদিবাসী ও অধিবাসীরা যেমন সামন্তদের ভয়ে ভক্তি করে ঠিক তেমনি মাওবাদীদেরও ভয়েই ভক্তি করে। তাই মনে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম ষড়যন্ত্রের পর যারা ঐ রাজ্যের জঙ্গলমহলে ঘাঁটি গড়ে তুলতে পেরেছিল তারা ঐ অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে আবার তাদের পুরোন এবং নিরাপদ ডেরায় ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে, কমবেশি নাশকতা ঘটিয়ে এবং একটি বিশিষ্ট রাজনেতাকে ভয় দেখিয়ে তারা ভারত বন্ধের উপলক্ষ্যে এই কথাটাই বলল।