১২০ কোটি জনসংখ্যা হয়ে ভারত সরকারের পোয়াবারো। সবার কাছ থেকে দিনে দু’টাকা বাড়তি আদায় করে নিতে পারলেই ঘাটতি থাকেনা। তাই নির্বিঘ্নে সরকার চলে। জনসংখ্যাই এই সরকারকে চাঁদা তুলে বাঁচিয়ে রেখেছে। মাঝখান থেকে কিছু বিত্তবান মাছির মতো ভ্যানভ্যান করছে। আজ তারাই মানুষকে মাছি ভাবছে। তারা তাদের সম্পত্তির ওপর থেকে মানুষের মালিকানা সরিয়ে ফেলছে।
৩০ হাজার কোটি টাকার বিলগ্নীকরণ। অর্থাৎ এই বাজেটে ৩০ হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি বেচে দেওয়ার ফন্দি করা হয়েছে। বিত্তবানদের হাতে সরকারি সম্পত্তি খুশি মনে বেচে দিয়ে সরকার ঝাড়াঝাপটা হাত পা নিয়ে চেয়ারে ঠ্যাং দুলিয়ে মানুষের ওপর বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স চাপিয়ে ট্যাক্স আদায়ের কাজটি ছাড়া আর কিছু করবেনা মনস্থ করেছে। প্রতি বাজেটেই তাই করের হার বেড়ে যায়। উন্নয়নমূলক প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়লেও ওই খাতে পুরো টাকা খরচ করার মতো ইচ্ছাশক্তি কমে যায়। অপুষ্টির এই দেশে খাদ্যেও ভরতুকি কমিয়ে দিতে এই সরকারের লজ্জা হয়না। আগামী তিন বছরে ভরতুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে দিয়ে সরকারকে ভরতুকিমুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে দেওয়া গেছে।
সারের ওপর থেকে ৬০০০ কোটি টাকার বেশি ভরতুকি ছাঁটাই করা হয়েছে। অনেক আগেই সারের দাম বিনিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সরকার সারের দাম ঠিক করবেনা। সার শিল্পের বেসরকারি মালিকদের ওই দায়িত্ব তুলে দিয়েছে সরকার। প্রতিবছর সারের ওপর ভরতুকি কমিয়ে দিয়ে সারের দাম বাড়াতে সাহায্য করছে সরকার। কৃষকের দুরবস্থার কথা চিন্তা করার সামর্থ্য নেই এই সরকারের। জ্বালানির ওপর ২৫ হাজার কোটি টাকার ভরতুকি ছাঁটাই হয়েছে। ভরতুকি দিতে থাকলে নাকি দেশের উন্নতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ ধনীদের কর ছেড়ে দিতে পারলে সরকার শান্তিতে থাকতে পারে। চলতি বছরে ৫ লক্ষ ২২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখিয়েছে সরকার। আবার বিত্তবানদের খুশি করতে ৫ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকার কর মকুব করেছে সরকার। ধনীদের খুশি করার জন্যে নানারকম করে ছাড় দেওয়া হয়। আর আর্থিক ঘাটতি মেটাতে মানুষের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই রকম ক্রমাগত হয়ে চলেছে।
বিগত কুড়ি বছরে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ গরীব হয়ে গেলেও গুটিকয়েক বিত্তবান বেড়ে গেছেন। এইসব বিত্তবানেরা সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তাঁরাই রাজনৈতিক দল পরিচালনা করছেন। রাজনেতাদের দায় দৈবে টাকা পয়সা দিচ্ছেন। এইসব বিত্তবানদের খুশি করতে বছরের পর বছর তাদের কর মাফ করতে হয়। লগ্নী না করার হুমকি দেন তাঁরা। একদিকে এঁরাই সরকারি সম্পত্তি কিনে নিচ্ছেন। অন্যদিকে অসংখ্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে লগ্নী করছেন। লাভ করার জন্যেই লগ্নী করছেন। সরকারি সাহায্যে লাভ করে তাঁরা বিত্তের শিখরে চেপে যাচ্ছেন। মানুষ তাঁদেরই খুশি করতে বেশি করে কর দিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কর্মচারীদের পেনশন ফান্ডের সুদের হার কমিয়ে দিয়ে পকেটমারি করছে সরকার।
এইরকম উদ্ভট পরিকল্পনায় আমাদের দেশও চলছে। ভারতের অবস্থা এখন বিচিত্র। বছর বছর জনা পাঁচেক ধনীবৃদ্ধির তালিকায় ভারতবাসী ঢুকে পড়ছে। অথচ অর্ধভূক্ত লোকের সংখ্যা দিনের দিন এই ভারতেই বেড়ে চলেছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অপুষ্টির শিকার শিশু ও নারী ভারতে আছেন। সবচেয়ে বেশি অশিক্ষিত ভারতে থাকেন। ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়ার দৌড়ে রুগ্ন পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলেছে।
সরকারি রোজগার বাড়ানোর ফরমুলা একই থাকল। ৪০০০ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ কর ছাড় দিয়ে রাজস্ব সংগ্রহের জন্যে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল অতিরিক্ত করের বোঝা। প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করার জন্যে পরিষেবা করা এবং অন্তঃশুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে যে কোন জিনিসের দাম আবার বাড়বে। অন্যদিকে ফাটকা বাজারে টাকা লেনদেনের জন্যে কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট করের ওপর বাড়তি কোন বোঝা চাপানো হয়নি। এর ফলে শিল্পমহল অখুশি থেকেও খুশি হয়েছে। তাদের ইচ্ছে ছিল কর্পোরেট কর কমিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এই মন্দার বাজারে অর্থমন্ত্রী কর কমানোর মতো ঔদার্য্য দেখাতে সাহস করেননি।
মানুষের বিপদ বেশি। মানুষ এখন শাঁখের করাতে কাটা পড়ছে। নতুন বাজেট এলে বাড়তি খরচ। আবার বাজেটের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজস্ব সংগ্রহ হয়নি বলে ঘাটতি মেটাতে আবার খরচ। বাজেটের ফলে অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করছেন মানুষ। পরিকল্পনা নেয় সরকার। পরিকল্পনায় থেকে যায় গলদ। চলতি আর্থিক বছরের ঘাটতির কারণ হিসেবে বিলগ্নী খাতে কম আদায় এবং ভরতুকির জন্যে খরচ বৃদ্ধিকে দেখানো হয়েছে। রাজস্ব সংগ্রহের ঘাটতি হয়েছে এমন উল্লেখ রয়েছে। রাজস্ব সংগ্রহ কম হল কেন? সরকারের গাফিলতির জন্যেই হয়েছে। তাহলে করের বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপবে কেন? আগামী বছরে রাজস্ব সংগ্রহ কম হবেনা তা কে বলতে পারবেন? পরের বাজেটেও আবার এইসব কারণ দেখিয়ে ঘাটতি মেটাতে মানুষের মাথায় করের বোঝা চাপানোর সহজ সিদ্ধান্ত থেকে সরকার বিরত থাকবেন না।
গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়েছে রেল বাজেট। রেল এখন দেউলিয়া। ‘আইসিইউ’ থেকে রেলকে লাইনে ফেলতে বাজেটে যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে দিয়ে এখন কাঁদুনি গাইছে যে আট বছর যাত্রীভাড়া বাড়েনি। বাজেট প্রস্তাব সংসদে নিয়ে আসার কয়েকদিন আগে কুড়ি শতাংশ পণ্যমাশুল বাড়িয়ে দিয়ে যে কোন বস্তুর দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্য করেছে সরকার। পরিকল্পনা রূপায়নে মানুষের মাথায় করের বোঝা। পরিকল্পনায় অকৃতকার্য হলে পুনর্পরিকল্পনা। আবার মাথায় করের বোঝা।
মুদ্রাস্ফীতি যে আরও বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রইলনা। অর্থনীতির বিকাশ কি শুধু কর চাপিয়ে সম্ভব? যারা কর দিতে পারে তাদের কর মকুব করে দেওয়া হচ্ছে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতাও নেই তাদের ওপর বাজেটের অছিলায় ফিবছর জোর করে বাড়তি কর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই বলছি এই সরকার গাঁটকাটা সরকার। এই সরকার পকেটমার সরকার।