নেড়ি কুকুরটার নাম টমি। পঞ্চা টমির পেটে ক্যাঁত করে একটা লাথি মারতেই কুকুরটা লেজ পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দৌড় মারল। সেই দেখে পঞ্চা আনন্দ পেল। একদিন টমি ক্ষিদের জ্বালায় পঞ্চার বাড়ির হেঁসেলে ঢুকে হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে ভাত খেয়ে ফেলেছে। তারপর থেকেই পঞ্চার খুব রাগ। দেখলেই তাড়া করে। লাথি না মেরে শান্তি পায়না। টমি তিনকড়ির সেলুনের পেছনে আসশ্যাওড়া গাছের ঘন ঝোপের মধ্যে এমন ভাবে লুকিয়ে থাকে যে অন্য কুকুরও ওকে দেখতে পায়না। শুধু ক্ষিদে পেলেই ছুঁকছুঁক করে। ঘুরঘুর করে। পঞ্চাকে ও খুব ভয় পায়।
হরির ছোট ছেলে ওকে ছোট বেলায় সপ্তাহখানেক রেখেছিল। ছেলেটাই টমি নামটা রেখেছিল। মামার বাড়ির রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিল। ঘর নোংরা করছে দেখে হরির বৌ ছেলেকে দু’ঘা কষিয়ে টমিকে বাড়িছাড়া করিয়েছে। পাড়ার এঁটোকাঁটা কুড়িয়ে খায়। মিষ্টির দোকানে যায়। ডালভাতের হোটেলেও যায়। যা পায় খায়। মাংসের দোকানে মাঝে মাঝে যাওয়ার সুযোগ পায়।
মাংসের দোকানের আশেপাশে তিনটে ষন্ডামার্কা কুকুর আছে। এরা থাকে একসঙ্গে। কিন্তু এদের মধ্যে মিল নেই। বখরায় কম পড়লেই সবাই মিলে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। কামড়াকামড়ি রক্তারক্তি করে। কালো রঙের কুকুরটার তো এইসব করে একটা কান কাটা গেছে। আরেকটার একটা চোখই নেই। একদিন তো অসহ্য হয়ে মাংসের দোকানদার ছুরি ছুঁড়ে এক কোপে এদের মাকেই মেরে ফেলেছে। তখন ওরা বাচ্চা বাচ্চা। তখন থেকেই ওরা একসঙ্গে। ওরা আবার সবাই মিলে টমিকে দেখলেই তাড়া করে। ওই তিনটে যখন ভরাপেটে ঘুম লাগায় টমি টুক করে একবার মাংসের দোকান ঘুরে নেয়। কোন কোন দিন কিছু পায়। বেশির ভাগ দিন কিছুই পায়না।
পাড়ার উল্টোদিকে পুকুর পাড়ে আরও তিনটে কুকুর থাকে। তারা সুখী। পুকুর পাহারা দেয়। শেয়াল বেড়াল এলে তাড়ায়। পুকুরের মালিক এদের পোষে। মাংসের ছাঁট পেলে নিয়ে এসে খাওয়ায়। আবার মালিক ক্ষেপে থাকলে ওদের পিটিয়ে দেয়। এদের কাছে টমি ভেড়েনা। ওরা তেড়ে আসে। সবাই নেড়ি হলে কি হবে পুকুরের কুকুরগুলো নিজেদের কুলীন ভাবে। মাংসের দোকানের কুকুরগুলোও পুকুর পাড়ে যায়না। এইতো গেল আমাদের পাড়ার কুকুরের হিসেব।
সেদিন পঞ্চা তিনকড়ির সেলুনে চুল কাটার লম্বা লাইন দেখে খবরের কাগজের মাঝখানের পাতাটায় মাথা ঝুঁকিয়ে বিস্কুটের বিজ্ঞাপন দেখছিল। টমি লেজ গুটিয়ে গুটি পায়ে ওর চোখে চোখ না রেখে সেলুনের পেছনে গিয়ে একটু আরাম করবে বলে এগোচ্ছিল। পঞ্চা দেখে ফেলল। ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হল। পঞ্চার পা নিশপিশ করতে শুরু করল। পঞ্চা খবরের কাগজটা বেঞ্চিতে রেখে সেলুনের পেছন দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে আবার ক্যাঁত করে লাথি মারল।
এরপর যা হল, সেটা সারা গ্রামে চর্চার বিষয় হয়ে উঠল কয়েকদিন। টমি এবার তেড়ে এল পঞ্চার দিকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যখন কিছু করার থাকেনা তখন অনেকেই এরকম ফুঁসে ওঠে। পঞ্চা আরও রেগে পায়ের চপ্পলটা খুলে ছুঁড়ে মারল। লাগলনা। টমি এবার দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছে। লম্বা লম্বা দাঁতগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে কামড়ে দিতে পারে। পঞ্চা বেগতিক দেখে দৌড়োতে শুরু করল। টমি দৌড়োচ্ছে পঞ্চার পেছনে। ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। তাই শুনে মাংসের দোকানের তিনটে কুকুরও পঞ্চার পেছনে লেগে গেল। চারটে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। পঞ্চা দৌড়ে কোথায় যাবে বুঝতে পারছেনা। চারটে কুকুরের আওয়াজ শুনে পুকুর পাড়ের সুখী কুকুরগুলোও গলা ছাড়ল। ওদের গলাগুলো বাজখাঁই। পঞ্চার ওপর সবার রাগ না থাকলেও মানুষের ওপর ওদের সবার রাগ আছেই। নাহলে একসঙ্গে এতগুলো কুকুর মিলে ওকে তাড়া কেন করবে! তারপর পঞ্চা কিন্তু আর কুকুরের পেটে লাথি মারেনি।
এরপর মাংসের দোকানের কুকুরগুলোর টমির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। পুকুর পাড়ের কুকুরগুলোও আর এদের দেখে ঘেউঘেউ করে তাড়া করেনা। ওরা বুঝে গেছে ওরা কুকুরের জাত। ওরা মানুষের চেয়ে আলাদা জাতের। পিঠ বাঁচাতে ওরা মনে হয় দল বেঁধে থাকছে আজকাল।