Flickr Gallery

Wednesday, June 5, 2019

শব্দকল্পদ্রুম ভাগ ২ঃ গোরুই আসল প্রোলেতারিয়েত



গোরু একটি প্রোলেতারিয়েত প্রাণি। গোরুর নিজের বলতে কিছুই নেই। গোয়ালা তাকে দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। আর সকাল বিকেল দোহন করে। তাহলে গোয়ালাকে বুর্জোয়া বলা যেতে পারে। বুর্জোয়া গোয়ালা গোরুকে যেটুকু খেতে দেয় তার অনেক বেশি লাভ করে দুধ বেচে। লাভের অংশে গোরুর কোন ভাগ নেই। সমাজবিজ্ঞানী মার্ক্স গোরুদরদী ছিলেন। তিনি ‘ক্যাপিটাল’ বইটিতে এই গোয়ালার লাভ লোকসান নিয়ে লিখেছিলেন। তৎকালীন ইউরোপিয়ান সমাজের পুঁজির আবির্ভাব ও গোয়ালার সঙ্গে গোরুর দ্বন্দ্ব নিয়ে তিনি অনেক কথা বলেছেন। গোয়ালা যদি বুর্জোয়া হয় তবে ময়রা মানে ক্যাপিটালিস্ট।

ময়রা নানারকমের মিষ্টি বানিয়ে বেচে প্রচুর লাভ করছে। তবে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ময়রাকে বুর্জোয়া বলে ভাবলে গোয়ালাকে পেটি বুর্জোয়া বলতে হয়। কারণ ময়রা গোয়ালাকে শোষণ করে। দুধের দাম কম দেয়। গোয়ালা বুর্জোয়া বা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণির হলেও গোরু কখনো ক্যাপিটালিস্ট হতে পারছেনা। অন্যদিকে পুঁজিবাদী ময়রা তার কারখানার আধুনিকীকরণ করে, উৎপাদনের মাত্রা বাড়িয়ে, একচেটিয়া বাজার দখলের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ময়রা তার মিষ্টির দোকানের অনেকগুলো শাখা খুলে ফেলছে।

মার্কেন্টাইল ক্যাপিটাল বা বণিক পুঁজি থেকে শিল্প পুঁজি হয়ে গেল। এর পরের ধাপ আর্থিক পুঁজি। ময়রার কাছে পুঁজি বেড়েই চলেছে। প্রচুর লাভ। পুঁজিবাদের পরের ধাপ সাম্রাজ্যবাদ। উদ্বৃত্ত পুঁজির সাহায্যে ময়রা তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলল। ময়রা গোরু আর গোয়ালার চেয়ে ক্ষমতাশীল হয়ে গেল। এইভাবেই ময়রা পুঁজি খাটিয়ে রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল।

গোরুর ব্যবহার গ্রামের চাষাবাদে লাগে। গোরু লাঙল বয়। হল কাঁধের ওপর রেখে রেখে কাঁধ কড়া হয়ে যায়। তাও মনিবের স্বার্থে কাজ করে চলে। চাষী গোরুর ল্যাজে মোচর দিয়ে আর পিঠের ওপর বেত পিটিয়ে নিজের জমি চাষ করিয়ে কাজ হাসিল করে। মার্ক্সের সূত্র ধরে গোরুকে প্রোলেতারিয়েত বললে চাষীকে বলতে হয় সামন্তবাদী। সামন্তবাদী মানসিকতার জন্যেই গোরু নামের নিরীহ প্রোলেতারিয়েতকে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে সামন্তবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্যে প্রতিদিন রোদ জল ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও পরিশ্রম করে যেতে হয়।

মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় ইতিহাসে গোরুকে প্রোলেতারিয়েত ভাবা হলেও ভারতীয় ইতিহাসে প্রগতিশীল শক্তিসমূহ গোরুকে মাতৃরূপে দেখে। গোভক্তি এখানে নতুন অক্ষশক্তির সৃষ্টি করেছে। এখানে যারা গোরুর ভক্তিকে আদিখ্যেতা ভাবে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবা হচ্ছে। এখানে প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। তার্কিক দ্বন্দ্ব তো আছেই। তার সঙ্গে গুঁতোগুঁতি, খুনোখুনি আছে। দ্বন্দ্বের এই বাহ্যিক রূপটির নাম দৈহিক দ্বন্দ্ব। ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এই দ্বন্দ্বটি নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। কেউ এই প্রোলেতারিয়েত প্রাণির প্রতি ন্যূনতম সমবেদনা না জানালে বা এই প্রজাতির বিপক্ষে গেলে তাকে দেশদ্রোহী ভাবা হচ্ছে। ইটালির ফ্যাসিস্ট পার্টির মতোই রাষ্ট্রবাদী প্রগতিশীল মানুষ গোরুর স্বার্থে কাজ করছে। তবে এইখানে আরেকটা দ্বন্দ্ব আছে। ভাববাদ আর বস্তুবাদ মিলে এই জায়গায় একটা প্যাঁচ লেগে গেছে।

দেখা গেছে ভাববাদী প্রগতিশীল গোরুপ্রেমীরাও বাছুরকে বঞ্চিত করে গোরুর দুধ খাচ্ছে। গোরু দোহনের দুধ খেয়ে তাদের বাচ্চারা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে বড় হচ্ছে। অথচ গোরু বাঁচাতে গলা ফাটাচ্ছে। এই ধরণের ভাববাদী গোরক্ষক প্রগতিশীল শক্তিকে অনেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হিসেবে শনাক্ত করছেন।

এতো গেল গোরুর জীবন। তাছাড়া গোরুর একটা লেজ আছে। চারটে পা আছে। দুটো কান আছে। ছেলে বা এঁড়ে গোরুকে ষাঁড় বলা হয়। বাজারে ঘোরা এঁড়ে গোরুকে লুম্পেন প্রোলেতারিয়েত বলা যায়। গোবিষ্ঠাকে গোবর বলে। বুর্জোয়া গোয়ালা আর সামন্তবাদী চাষা গোবরের উপযোগিতা জেনে এরদ্বারাও পুঁজি তৈরি করতে সক্ষম। গোরু নিজের সবটুকু দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে সর্বহারাই থেকে যাচ্ছে। গোরু তার শিং-এর ব্যবহার করছেনা। উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবের ফলে এরা শিং দিয়ে গুঁতিয়ে বিপ্লব আনতে পারছেনা। 

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
বাংলা ব্লগ জগতের সিন্ধুতে আমরাও একটা বিন্দু। নেট ঘেঁটো বাঙালির আপ্যায়ণে বড় হচ্ছে। শৌভিকের লেখা পড়তে এই ব্লগে যান LEKHASHAUBHIK.BLOGSPOT.COM