Flickr Gallery

Thursday, October 27, 2016

বিরসা মুণ্ডার জীবন কথা

ঝাড়খণ্ডের প্রায় সব লোকই আদিবাসিদের এই রক্ত ঝরানো সংঘর্ষের বছরগুলির কথা ভুলে গেছেন। রাঁচিতে লালপুর থেকে কোকর যাওয়ার রাস্তায় ডিস্টিলারি পুল পর্যন্ত বসে তরকারি আর মাছের বাজার। মাছের বাজার শেষ হলেই বিরসার সমাধিস্থল। এখন বিরসার জন্মলগ্নে শসকরা এসে তাঁদের পসধূলি দিয়ে বিরসার সমাধি ধন্য করে দিয়ে যান। তাছাড়া সারা বছর বিরসার সমাধিতে আগাছা ভরে থাকে। মন্ত্রীরা আর নেতারা এসে একগাদা গাঁদা গুলের মালা ছড়িয়ে বলেন, বিরসা মুণ্ডাঅমর রহে। বিরসা ভগবান কি জয়।

রাঁচিতে বিরসার স্মৃতিরক্ষার্থে হরেক রকম প্রচেষ্টা হয়েছে। রাঁচিতে অনেক বড় বড় ও ছোটখাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের পাশে বিরসার নাম লাগানো। রাঁচিতে একটা নামকরা চৌমাথার নাম বিরসা চক। নতুন একটা স্টেডিয়াম বিরসার নামে তৈরি হল। চিড়িয়াখানার নামের সঙ্গেও বিরসা আছেন। রাঁচিতে বিরসার নামে এত কিছু আছে বলে সাধারণ লোক বিরসার নামটুকু জানেন। নাম জানা থাকলেও বিরসার পঁচিশ বছরের জীবনকাল জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয়না। বিরসা আজও পরিত্যক্ত। বিরসার শহর রাঁচিতেই তিনি ব্রাত্য। বিরসার কৃষক বিদ্রোহের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। তাঁর গণবিদ্রোহের ধামসা মাদোল আর বাজেনা।

বলা হয় বিরসার জন্ম উনিশ শতকে আশির দশক। উনিশ শতকের গোঁড়ার দশকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামোই ছিল বিরসার আবির্ভাবের ক্যানভাস। তখন কৃষক ও দিনমজুরদের ভোগান্তির অন্ত ছিলনা। একদিকে ইংরেজ সরকারের শাসন, অন্যদিকে জমিদারের অত্যাচার। আর দু’দিক দিয়েই আর্থিক ও দৈহিক শোষণ। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো শরীরের সমস্ত শক্তি চুষে ফেলত সাহেবরা। বেগার খাটা, জমি থেকে বেদখল করে দেওয়া ছিল রোজকার ঘটনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো ছিল দুর্ভিক্ষ। ছিল মহামারী। বলা হয় জেলে থাকাকালীন বিরসা মুণ্ডাও কলেরায় মারা গেছেন। জঙ্গলের আদিবাসিদের ক্রীতদাসে পরিণত করতে চেয়েছিল সাহেবরা। কিন্তু তারা সফল হয়নি।

আদিবাসিরা বরাবরই স্বাধীনচেতা। পরাধীনতার বেড়ি ছিঁড়ে তারা বরাবর বেরোতে চেষ্টা করত। তারা স্বাধীনতার লাভের জন্যে চোয়াল শক্ত করে লড়াই করছিল। লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে ও লড়াইয়ের হার জিত দিয়ে তারা আগামী দিনের কোন বড় লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জমিদার ও জাগিরদারদের হাতে নির্যাতলের জ্বালার নির্যাস থেকে তৈরি হচ্ছিল গণচেতনার বীজ। বিরসার আন্দোলন সেই বীজটির অঙ্কুর। 

ঝাড়খণ্ডের মূলতঃ রাঁচি, লোহারদাগা ও গুমলা অঞ্চলে মুণ্ডানামের এক জনজাতি বাস করে। আদিবাসি সমাজে মুণ্ডা মানে গ্রামের মোড়ল। পেশাগত ভাবে মুণ্ডারা ছিলেন গ্রামের মুখিয়া বা মাথা। তখনকার সমাজে মুণ্ডা নামটির সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা জড়িয়ে থাকত। তেমনি পাহাড়িয়া জনজাতির লোকেদের সরদার বলা হল। সরদারদের হাতে এক একটা বড়সড় এলাকার তদারকির ভার থাকত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমিদারদের ‘দেওয়ানি’ অধিকার কেড়ে নেওয়ার ফলে সরদারদেরও আধিকার খর্ব হয়। মুণ্ডাদের ঘন ঘন বিদ্রোহ ও সরদারদের বিদ্রোহ ১৭৮৯ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত চরমে ছিল। জমিদাররাও নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে বিদ্রোহ দমন করত। কিন্তু আদিবাসিদের গণচেতনা ছাই ঢাকা আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলত। বারেবারে বিদ্রোহ হত। বিশেষ করে ১৮১১, ১৮১৯-২০ ও ১৮৬২ সালে জমিদারদের বিরুদ্ধে মুণ্ডাদের বিদ্রোহ ব্যাপক রূপ নিয়েছিল।



বলা বাহুল্য, ইংরেজ শাসকরা ছিল চতুর। ওরা বশ্যতা স্বীকার করা হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের প্রচুর সাহায্য করত। সাহায্য পেয়ে অনেক জমিদার ফুলে ফেঁপে উঠল। পরোক্ষে ইংরেজরাই শক্তিশালী হত। ইংরেজ শাসকরা থখন শুধু জমিদারদেরই পক্ষে দাঁড়াত। আদিবাসিদের সুখ দুঃখ, অভাব অনটন ও রোগ ভোগ নিয়ে ইংরেজ শাসক আর তাদের অফিসারদের কোন মাথাব্যথা ছিলনা। সুবিধেবাদী বহিরাগত জমিদার বা ‘দিকু’র অধিকাংশই ছিল ভোগী। তাদের স্ফূর্তি কারা ছেড়ে আদিবাসিদের কথা শোনার সময় ছিলনা।

রাঁচি অঞ্চলে ইংরেজদের অনুপ্রবেশ ও বহিরাগত জমিদারদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি মুণ্ডাদের অসহ্য লাগছিল। তার সঙ্গে সাদা সরল আদিবাসিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, আর্থিক ও শারীরিক শোষণ সংক্রান্ত অভিযোগ মনের মধ্য গুমরে থেকে বারুদের কাজ করছিল। জাগিরদার ও জমিদাররা ইংরেজদের কাছ থেকে বিশাল বিশাল ভূকন্ডের মালিকানা আদায় করত। কখনো সৈন্যশিবির করার জন্যে জায়গার আবদারে কখনো বা মন্দির, মসজিদ বা গির্জাঘর করার নামে। এর ফলে জঙ্গলের পর জঙ্গল, গ্রামের পর গ্রাম চলে যেত জমিদারদের দখলে। পাহাড়, নদী ও রাস্তাও হয়ে যেত জমিদারদের। আদিবাসিরা জমি থেকে বেদখল হয়ে যেত। জঙ্গল ছেড়ে পালাল অনেকে। জঙ্গলের অধিকার খর্ব হল। মুণ্ডারা এই ব্যবস্থাও সহ্য করতে পারতনা। 

বিদ্রোহের কারণ যতই গুরুতর হোক না কেন, বা মুণ্ডারা যতই ঘন ঘন বিদ্রোহ করুক না কেন, বিভিন্ন সময় জুড়ে মুণ্ডাবিদ্রোহ ওদের জন্যে কোল সুফল আদায় করতে পারেনি। বরং তারা আরও কঠিন দুরাবস্থার মধ্যে পড়ে যায়। ওদিকে ইংরেজ শাসকের সুরক্ষার মোড়কে জমিদাররা দিব্যি খোসমেজাজে দিন কাটাচ্ছে। বিদ্রোহ দমন করার জন্যে ইংরেজদের কাছ থেকে সৈন্যসাহায্য পেয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো জমিদাররা বছরের পর বছর আদিবাসিদের ভয় সিঁটকে থাকছে। আবার সুযোগ পেলে নির্মম ভাবে বিদ্রোহ দমন করতে অত্যাচারী হয়ে উঠছে। প্রতিশোখস্পৃহায় অনেক জমিদারের জিভ লকলক করত।

এরপর শুরু হল সরদার আন্দোলন। ১৮৫৯-৮১ সাল পর্যন্ত চলে সরদার আন্দোলন। সরদারদের লড়াইয়ের নাম ছিল ‘মুলকি লড়াই’। জমিদারদের ক্ষমতাচ্যূত করে বিতাড়িত করারই নাম ছিল মুলকি লড়াই। সরদাররা জমিদারদের অস্বীকার করতে শুরু করল। জমির খজনা দিতেও অস্বীকার করল।তাদের কথায়, তাদের পূর্বপুরুষের জমিজমায় দিকুরা অধিকার ফলায় কোন সাহসে! তারা বলত জমি, জঙ্গল আর জল তাদের ছিল। তাদেরই থাকবে। শুধু তাড়াতে হবে দিকুদের। তারা জানত একমাত্র তারাই তাড়াতে পারবে দিকুদের। কৃষকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল। ১৮৫৮ সাল থকেই সরদাররা মারমার-কাটকাট লাগিয়ে দিয়েছিল। জমিদাররাও বুঝতে পারছিল যে এ আগুন সহজে নিভবার নয়। আদিবাসিরা যুগ সুগ ধরে অভিযোগ পুষে রেখেছিল। আজ তা বারুদের স্তূপে পরিণত হয়েছে। ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। জমিদারদের দখলে থাকা বড় বড় ভূখন্ড সরদারদের দখলে চলে এল। সেইসময়ে সরদাররা ব্যাপক মুক্তাঞ্চল জুড়ে স্বঘোষিত এক স্বাধীন রাজ্যের পত্তন করেছিল।

এই রকম ভাবেই চলছিল। বারে বারে বিদ্রোহ দমন করা হচ্ছিল। ১৮৯০ সাল নাগাদ সরদার আন্দোলন একটি রাজনৈতিক পরিকাঠামোয় সংগঠিত হতে শুরু করল। আদিবাসিরা এই সময়ে জমি আদায়ের জন্যে আইনের দ্বারস্থ হয়।

ঠিক এই সময়ে আবার একদল সরদার নিজেদের বিদ্রোহী ঘোষিত করল। ইংরেজরা এই সমস্ত বিদ্রোহীদের নাম দিল ‘নিও সরদার’। নিও সরদাররা তখনকার সংবিধানের তোয়াক্কা করতনা। ইংরেজ শাসকের আইন অমান্য করত। তারা মনে করত জমিদার নয়, ইংরেজ শাসকরাই তাদের যাবতীয় দুঃখ দুর্দশার কারণ। জমিদাররা তো ইংরেজদের প্রশ্রয় পেয়ে শক্তিশালী। ইংরেজরা না থাকলে জমিদারদের শক্তিও আপনা আপনি কমে যাবে। তাই নিও সরদাররা মনে করত ইংরেজরা তাদের পয়লা নম্বরের শত্রু। ইংরেজ শাসক ও তাদের অফিসাররা দেশ থেকে বিতাড়িত হলে তাদের কষ্ট লাঘব হবে। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে পালালে স্বাধীনতা ফিরতে বাদ্য। ইংরেজ না থাকলে জমিদারও থাকবেনা। জমিদাররা তো ইংরেজদের স্বার্থ সিদ্ধির যন্ত্র।

নিও সরদারদের লড়াই শুরু হল। এর নাম সরদারি লড়াই। রাঁচির আশেপাশের অঞ্চলের আদিবাসিদের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই। সরদারদের হাতে থাকত তীর ধনুক। আর ইংরেজ পুলিশের হাতে থাকত বন্দুক। সাংগঠনিক ভাবে সরদারি লড়াই উচ্চপর্যায়ের বিদ্রোহ হলেও এই সময়ে নেতৃত্বের অভাব ছিল। আদিবাসি গোষ্ঠীগুলির সবাই চাইছিল কোন মহাপুরুষ বা অবতার এসে তাদের উদ্ধার করুন। তারা সরদারি লড়াইয়ের কালেও নিজেদের এক সূত্রে বেঁধে রাখতে পারেনি। মুণ্ডাদের মদ্যেও সংঘাত লেগেই থাকত। তারা এক কিংবদন্তীর খোঁজ করছিল। স্বার্থরক্ষার জন্যে আদিবাসিরা নিজেদের মধ্যে লড়তে থাকলেও সবাই অবিসংবাদিত নেতৃত্বপ্রদানকারী ব্যক্তিত্বের কামনা করছিল। যিনি হবেন কিংবদন্তী। যিনি হবেন তাদের ভগবান। যিনি হবেন মহাপুরুষ।

এই সময়ে রাঁচির অনতিদূরে উলিহাতু গ্রামে এক মুণ্ডাবাড়িতে ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর বিরসার জন্ম হয়। এগারো বছর বয়সে বিরসা চাইবাসায় আসেন। তিনি বছর চারেক চাইবাসায় ছিলেন। সেখানে তিনি এক মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৮৮৬ থকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ঐ স্কুলে ছিলেন। কিন্তু বেশি দিন তিনি ঐ স্কুলে থাকতে পারেননি। স্কুল শিক্ষক ডাঃ নাট্রট সাহেবের প্রবচনে তিনি মুগ্ধ হয়ে উঠতেন। নাট্রট সাহেব বলতেন আদিবাসিরা যদি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যায় তবে তারা তাদের হারানো জমি ফেরত পাবে। হারানো জমি ফিরে পাওয়ার কল্পনা বিরসাকে আন্দোলিত করত। বিরসা নাট্রট সাহেবের গুণগ্রাহী হয়ে উঠলেন। তবে বিরসার সাহেব মোগ বেশি দিন স্থির থাকেনি। একদিন বিরসা ঐ সাহেবেরই মুখ থেকে সুনে ফেললেন যে আদিবাসিরা নাকি ঠগ। সরদাররা নাকি চোর! বিরসা বুঝতে দেরি করলেন না। তিনি নাট্রট সাহেবের বিরুদ্ধে সমালোচনা করলেন। সাহেবও যথারীতি বিরসাকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করলেন।

জঙ্গলই হল আদবাসীদের প্রাকৃতিক বাসস্থল। ওরা নিজেদের তাগিদেই জঙ্গল রক্ষা করে। জমির লড়াইতে কারা যে ঠগ তা মুণ্ডারা অনেকদিন আগে থেকেই জনত। সেই ঠগ সাহেবরাই আদিবাসিদের ঠগ বলে অপমান করল! খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের ওপর বিরসার বিদ্বেষ জন্ম নেয়। বিরসা তখন থেকেই শাসকদের ঘৃণা করতে শুরু করলেন। রাঁচি অঞ্চলের আদবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরসা যুক্ত হয়ে পড়লেন। তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরদার আন্দোলন চলছিল। বিরসাও জল, জঙ্গল ও জমি রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

পনের বছর বয়সে বিরসা বড়গাঁওতে এক বৈষ্ণব গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেই গুরুর নাম আনন্দ পাঁড়ে। আনন্দ পাঁড়ে একদিকে ধর্ম শিক্ষা দিতেন। অন্যদিকে আবার তিনি বহিরাগত শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস যোগাতেন। তাঁর শিক্ষা ছিল ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণ। মুণ্ডারা সবাই সেই গুরুকে ভালবাসত। বলা হয় গুরুর পাঠশালায় থাকাকালীন বিরসা পৈতে ধারণ করে ব্রাহ্মণত্ব পেয়েছিলেন। এও শোনা যায় যে তিনি ব্রাহ্মণ্য প্রদর্শনের জন্যে কপালে চন্দনের টীকা ধারণ করতেন। তিনি তুলসী পুজো করতেন। ধার্মিক শিক্ষা ছাড়াও গুরুর কাছে তিনি রাজনৈতিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। জল, জঙ্গল ও জমি রক্ষার লড়াইতে বিরসার পদার্পণ এইখানেই।

এই সময়ে ইংরেজরা আদিবাসিদের কাছ থেকে জঙ্গলের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ১৮৮২ সালের ভারতীয় বন আইন কার্যকর করতে ইংরেজ শাসক তৎপর ছিল। এই অঞ্চলের জঙ্গলের অধিকার শাসকের হাতে চলে গেল। এমন কি গ্রামের আশপাশের জমিও ইংরেজরা আইনি ভাবে হাতিয়ে নিল। আইন দ্বারা সংরক্ষিত জমির ওপর আর আদিবাসিদের অধিকার থাকল না। যুগ যুগান্ত ধরে যাদের জঙ্গলে বাস তাদের বাসস্থানের গণ্ডি সীমিত হয়ে গেল। যে বনজ সম্পদের অপর আদিবাসিদের অবাধ অধিকার ছিল এবং যাদের বনের ওপর ভরসা করে জীবিকা নির্ভর করত তাতে বাধা দিল ইংরেজ পুলিশ। প্রকৃতি যাদের বন সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিল। সরকার বাহাদুর তাদেরই অসংরক্ষিত করে তুলল। বিরসার আবির্ভাব এখানে বারুদের স্তূপে স্ফূলিঙ্গের কাজ করল। জঙ্গলবাসীরাও আন্দোলন শুরু করল। জমির আন্দোলন। জমি রক্ষার আন্দোলন। শুরু হল কৃষক আন্দোলন। বিরসার নেতৃত্বে আন্দোলন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিরসা কিংবদন্তী হয়ে গেলেন। বিরসার নেতৃত্বের কথা জঙ্গলে জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ল। আদিবাসিরা আন্দাজ করলেন সেই মহাপুরুষ এসে গেছেন। এই মহাপুরুষই ইংরেজদের তাড়াতে পাড়বেন। দলে দলে লোক বিরসার কৃষক আন্দোলনে সামিল হয়ে গেল। বিভিন্ন আদিবাসি গোষ্ঠী, যারা এতদিন নিজেদের মধ্যেই লড়াই করত তারাও একজুট হল। বিরসার নেতৃত্বে আন্দোলন বৃহৎ রূপ নিল।

বিরসার নামে গল্পের অন্ত নেই। অনেক রকম গল্প তৈরি হল। কথিত আছে যে বিরসা নিজেকে ‘ধরতি আবা’ বা পৃথিবীর পিতা বলতেন। আবার শোনা যায়, তিনি নিজেকে দেবতার দূতও বলতেন। অনেকে বলে তিনি জিজেকে ভগবানও বলতেন। আবার এও শোনা যায় তিনি নাকি বাধ্য করিয়ে সমীহ আদায় করতেন। তিনি নাকি প্রচার করতেন যে, কোন লোক তাঁকে যদি ভগবান না বলে তবে তাকে হত্যা করা হবে। অবশ্য ভয়েই হোক বা ভক্তিতেই হোক, এখনও লোকে বিরসাকে ভগবানই বলে। এই সময়ে বিরসার অনুগামীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। বলা হয় বিরসার অনুগামীরাও নাকি পৈতে ধারণ করত। ওরা কপালে চন্দনের টীকাও লাগাত। বিরসা তাঁর বিশাল সংখ্যক অনুগামীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আর সেই বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইতে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছিল। শোনা যায় এই অনুগামীরা বলত, বিরসাকে ভগবান না বলা পাপ। আদিবাসিরা বিরসাকে ‘সিং বোঙ্গা’ বা সূর্য দেবতা বলত। তাঁকে আবার ‘খোসরা কোরা’ও বলা হত। গল্পে আছে আদিবাসিদের দেবতা খোসরা কোরা পৃথিবীর যাবতীয় অসুরকে ধ্বংস করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য বানিয়েছিলেন। আদিবাসিরা হয়তো ইংরেজ শাসকদের অসুরের সঙ্গে তুলনা করেছিল।

বিরসা সমাজ সংশোধনের কাজও করতেন। তিনি তাঁর অধিকৃত অঞ্চলে আইন করে চৌর্য্যবৃত্তি ও মিথ্যাচার নিষিদ্ধ করেছিলেন। আইন অমান্যকারীদের কঠিন দন্ডের ভাগীদার হতে হত। তিনি আইন করে মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি বহুপত্নী প্রথারও বিরোধী ছিলেন। তিনি মূর্তি পুজো পছন্দ করতেন না। আদিবাসি সমাজে ‘বোঙ্গা’ পুজো বা প্রেত পুজো তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ হেন এক মহাপুরুষের ঐশ্বরিক ক্কমতার গল্প চতুর্দিকে রটে গেল। জরাগ্রস্ত লোকেদের নাকি বিরসার স্পর্শ পেলে রোগ নিবারণ হত। দলে দলে আদিবাসিরা বিরসাকে দর্শন করতে আসতে শুরু করল। মুণ্ডারা ছাড়া এল ওরাওঁরা। খারিয়া জনগোষ্ঠীও এসে হাজির হল। সাদানি ভাষায় একটি লোকসঙ্গীতে আছে যে বিরসাকে দর্শন করতে হিন্দুরাও এসেছিল। মুসলমানরাও এসেছিল। জমিদাররাও এসেছিল। আদিবাসিদের বিরসার ওপর অগাধ আস্থা ছিল। ওরা বিরসাকে উদ্ধারকর্তা ভাবত। যদিও এই সমস্ত কাহিনীর কোন প্রমাণ কেউ পায়নি এবং বিরসার জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।

বলা হয় সরদার আন্দোলনের কাল ১৮৫৮-৮১ সাল পর্যন্তই। বিরসার বিদ্রোহ বা উলগুলান তার পরে। অর্থাৎ ১৮৯৫-১৯০০ সাল পর্যন্ত। তবে সরদাররা আগে থেকেই বিরসার মতো একজন নেতার কামনা করত। সরদাররা উৎসাহ নিয়ে উলগুলানে যোগ দিল। ইংরেজ শাসক, বহিরাগত জমিদার এমনকে আদবাসী ভূস্বামীদের দেশ ছাড়া করাতে কৃষকের গণবিদ্রোহে অংশ নিল। বিরসার অনুগামীরা আবার মুণ্ডারাজ ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। বিদ্রোহীরা ঘোষণা করল, জমি ও জঙ্গলের সবটুকু তাদেরই। বংশ পরম্পরায় তারা জঙ্গলের অধিকার ভোগ করে আসছে। এই অধিকার তারা ছাড়বেনা। জমি তাদের নিজেদের। সেই জমির আবার খাজনা কিসের! কৃষকের জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দল। বিশেষজ্ঞরা বলে যে উলগুলান বিদ্রোহ ছিল একটি সুসংগঠিত বিদ্রোহ।

১৮৯৫ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজ পুলিশ বিরসাকে গ্রেফতার করে। জানা গেছে তাঁর প্রায় সাত’শোর বেশি অনুগামী পুলিশের ঘাত থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইংরেজরা বাধ্য হয়ে বিরসাকে ছেড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। অবশ্য এই ঘটনার স্বল্পদিন পরেই পুলিশ বিরসাকে আবার গ্রেফতার করে। কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে দু’বছরের সাজা কাটিয়ে বিরসা ১৮৯৯ সালের নভেম্বর মাসে কারামুক্ত হন। এরপর তিনি আবার সবাইকে একত্রিত করে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।

১৮৯৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৯০০ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সময় ছিল। বন্দুকের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে তীর ধনুক দিয়ে ওরা লড়ত। তীর ধনুক দিয়েই ওরা ইংরেজদের ঠেকিয়ে রাখত। এই সময়ে খ্রিষ্টান মুণ্ডারাও উলগুলানে অংশ গ্রহণ করে। খুঁটি, তোরপা, কাররা, তামার, গুমলা ছাড়াও রাঁচির আশেপাশের অনেক জঙ্গলেও উলগুলানের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০০ সালের ২৮শে জানুয়ারি বিদ্রোহীরা পোরহাটে একটি জার্মান চার্চ পুড়িয়ে দেয়। বিদ্রোহীরা গেরিলা লড়াইও করত।

পুলিশ হন্যে হয়ে বিরসাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। বিদ্রোহকে নৃশংসভাবে দমন করছিল সেনাবাহিনী। ১৯০০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি ইংরেজ পুলিশের হাতে বিরসা ধরা পড়ে যান। তিনি আবার জেলে যান। বিরসা মুণ্ডা ১৯০০ সালের ৯ই জুন জেলেই দেহত্যাগ করেন। বলা হয় তাঁকে জেলের মধ্যে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আবার জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট বলতেন যে বিরসা নাকি কলেরাগ্রস্ত হয়ে মারা গেছেন।



ইংরেজ শাসকরা ছিল চতুর ও শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে বীর বিরসার উলগুলান ঝাড়খন্ডের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করে। বিরসার স্বপ্ন আজও সার্থক হয়নি। সেদিনকার মতো আজও অধিকাংশ আদিবাসি নির্যাতিত। ইংরেজরা নেই। জমিদারি নেই। তবে শাসনতন্ত্র এখনও দোষমুক্ত নয়। আদিবাসিরা এখনও ফুঁসছে। বারুদ এখনও তৈরি হচ্ছে। জঙ্গলের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যোজনা বিশ বাঁও জলে পড়ে আছে। তার ওপর বড় বড় উদ্যোগপতিদের জমি কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। আদিবাসিরা এখনও আতঙ্কে দিন কাটায়। এখনও তারা বিরসাকে পুজো করে। বিরসাই তাদের সাহস যোগায়। তাদের ভরসা যে বিরসা তাদের কাছে তাঁর মতোই কোন এক অবতারকে পাঠাবেন। যিনি আবার লড়াই করে আদিবাসিদের অধিকার রক্ষা করবেন। বিরসাই তাদের নায়ক। বিরসাই ভগবান। তাই আদিবাসিদের বিশ্বাস যে বিরসা আবার আসবেন।
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...
বাংলা ব্লগ জগতের সিন্ধুতে আমরাও একটা বিন্দু। নেট ঘেঁটো বাঙালির আপ্যায়ণে বড় হচ্ছে। শৌভিকের লেখা পড়তে এই ব্লগে যান LEKHASHAUBHIK.BLOGSPOT.COM